যুগে যুগে দলীয় আনুগত্য ও লেজুড়বৃত্তির শিরোপাস্বরূপ উপাচার্যের পদে অভিষিক্ত হয়ে বাংলাদেশের এক একজন উপাচার্য নতুন নতুন রেকর্ড স্থাপনের ঘোষণা দিয়ে থাকেন।
কেউ বলেন, এই বিশ্ববিদ্যালয়কে অতি দ্রুত বিশ্বমর্যাদায় আসীন করবেন, কেউ বলে থাকেন স্মরণকালের শ্রেষ্ঠ শিক্ষার পরিবেশ নিশ্চিত করা হবে… কত কথা। একইসাথে নানা ধরনের রেকর্ড স্থাপনের ফিরিস্তি। তবে এসবের কয়টা বাস্তবায়ন হয়, তা বলাই বাহুল্য। তবে এবার মনে হয় সেই আক্ষেপের অবসান হলো। কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য মহোদয় মনে হয় অনন্য একটা রেকর্ড করেই বসলেন। তিনিই মনে হয় বাংলাদেশ, এমনকি সারাবিশ্বের প্রথম মহামতি উপাচার্য যার বক্তব্য নিয়ে সংবাদ প্রকাশ করায় কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষার্থীকে এক বছরের জন্য বহিষ্কার করা হয়েছে। এমন অভূতপূর্ব, অনন্য আর মহান রেকর্ড পৃথিবীতে কোথাও আছে কি না সন্দেহ!
বুধবার রাতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে মহামতি উপাচার্য মহোদয়ের বক্তব্য সম্বলিত সংবাদটি দেখতে পাই। এরপর দেখতে পাই, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের কালজয়ী সেই অফিস আদেশ। বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার মো. আমিরুল হক চৌধুরি স্বাক্ষরিত সেই অফিস আদেশে এক বছরের জন্য বহিষ্কার করা হয়েছে ২০১৭-২০১৮ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী ইকবাল মনোয়ারকে। যাতে বলা হয়েছে, মার্কেটিং বিভাগের নবীন বরণ ও বিদায় অনুষ্ঠানে উপাচার্য ড. এ. এফ. এম. আব্দুল মঈনের বক্তব্যকে উদ্দেশ্যমূলকভাবে বিভ্রান্তিকর মিথ্যা প্রতিবেদন প্রকাশ করে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের সুনাম ক্ষুন্ন করায় বিশ্ববিদ্যালয়ের শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগে দৈনিক যায় যায় দিনের বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিবেদককে এক বছরের জন্য বহিষ্কার করা হলো। শুধু তাই নয়, এ ঘটনার তদন্তে গঠন করা হয়েছে উচ্চ পর্যায়ের একটি কমিটি। যারা সাত দিনের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দেবেন। সাত দিন পরে হয়তো ইকবাল মনোয়ারকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই বহিষ্কার করা হবে!
মহামান্য উপাচার্যের বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের অতি দ্রুত, অবিস্মরণীয় সিদ্ধান্তের পর উপাচার্য মহাশয়ের বক্তব্যটা শোনার খুব ইচ্ছে হলো। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম থেকে পেলাম ২.৪৬ সেকেন্ডের একটি অডিও। পুরো বক্তব্যটি আমি পাইনি। হয়তো পুরো বক্তব্য কেউ রেকর্ডও করেননি। যাই হোক, বক্তব্যে এটা পরিষ্কার মাননীয় উপাচার্য মহোদয় অত্যন্ত সুবক্তা। তিনি খুবই গোছালো, পরিষ্কারভাবে তার বক্তব্য রেখেছেন। দুর্নীতি নিয়ে তিনি অত্যন্ত তাত্ত্বিকভাবে নিজের মতামত তুলে ধরেছেন। তবে ‘দুর্নীতির কারণে সবার পকেটে এখন টাকা’। এই মহান বাক্য মেনে নিতে খুব কষ্ট হলো। ধরে নিলাম, উপাচার্য মহোদয় যে প্রেক্ষাপটে অকাট্য তত্ত্ব দিয়ে কথাগুলো বলেছে, সেটা হয়তো ইকবাল মনোয়ারের প্রতিবেদনে আসেনি। কিন্তু আমাদের কি এমন কথা বলা উচিত যা নিয়ে সমাজে প্রতিষ্ঠিত মূল্যবোধ আছে। একটা উদাহরণ দেওয়া যাক। এখন ক্রিস্টোফার নোলানের ওপেনহাইমার নিয়ে বেশ আলোচনা চলছে। এই সিনেমার একটা প্রেক্ষাপটে যুক্তি সহকারে বলা আছে, জাপানে প্রাণঘাতি পারমাণবিক বোমা ফেলা হবে কারণ এতে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অবসান হবে। হ্যারি কে ট্রুম্যানের ভাষায়, ছেলেরা ঘরে ফিরবে। এক্ষেত্রে মার্কিন প্রেসিডেন্টের যুক্তি ছিল অকাট্য, খুবই বাস্তবসমম্মত। কিন্তু তাই বলে কি, বিশ্বের মানবতাবাদী বিবেকবান মানুষেরা ট্রুম্যানের কি যুক্তিকেই মেনে নেবেন? হাততালি দেবেন, হিরোশিমা-নাগাসাকিতে বোমা হামলা যুক্তিসঙ্গত-যথাযথ ছিল বলে!
রেজিস্ট্রার স্বাক্ষরিত ঐ অফিস আদেশে জোর দেওয়া হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের সুনাম ক্ষুন্ন করা হয়েছে। উপাচার্যের বক্তব্য নিয়ে প্রকাশিত একটি সংবাদের কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ের সুনাম ক্ষুন্ন হয়েছে! আর যে সুনাম ফিরিয়ে আনতে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন, একজন শিক্ষার্থীকে বহিষ্কার করেছে। কি চমৎকার! কি অভূতপূর্ব সিদ্ধান্ত! কালজয়ী এই সিদ্ধান্তের কারণে সারাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আর সুধীজনদের কাছে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মান-সুনাম কতোটা বাড়লো, সে খবর কি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন রাখে।
কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই অফিস আদেশ দেখার পর আমার মনে একটা প্রশ্ন জেগেছে। তা হলো, একটা বিশ্ববিদ্যালয় আসলে কার? উপাচার্যের, শিক্ষকের, প্রক্টরের নাকি রেজিস্ট্রারের? আমি বিশ্বাস করি, বিশ্ববিদ্যালয় প্রকৃতপক্ষে শিক্ষার্থীদের। ছাত্র-ছাত্রীরাই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রাণ। কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ও ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের। এটা তাদের বিশ্ববিদ্যালয়। আর তাদের বিশ্ববিদ্যালয় যখন অসংবেদনশীলভাবে তাদের বিরুদ্ধেই ব্যবস্থা নেয়, ঠিক তখনই বিশ্ববিদ্যালয়ের সুনাম ক্ষুন্ন হয়। মানুষ ধিক্কার জানায়।
সুদর্শন, অত্যন্ত সুবক্তা উপাচার্যের বিরুদ্ধে আমার ব্যক্তিগত কোনো বিদ্ধেষ নেই। তবে ইকবাল মনোয়ারের বিরুদ্ধে যে অন্যায়, অসংবেদনশীল সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে তা অবিলম্বে তিনি প্রত্যাহার করবেন বলে আমার প্রত্যাশা। আর তা না হলে, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের সুনাম আরও ক্ষুন্ন হবে। তৈরি হবে আরেকটি গাভী বৃত্তান্তের গল্প।
ইকবাল মনোয়ারের বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার করুন, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় ইকবাল মনোয়ারদের কোনো উপাচার্যের নয়।
# প্রতিবেদনটি ডয়চে ভেলে থেকে সংগৃহিত
Last Updated on August 3, 2023 11:22 pm by প্রতি সময়