খাদি কোন সুতা বা কাপড়ের নাম নয়। পায়ে চালিত প্যাডেলের নিচে খাঁদ বা গর্ত করা হতো। আর সেখান থেকেই যে কাপড় উৎপন্ন হয় বলেই খাদি বলা হয়ে থাকে। কুমিল্লার খাদি কেবল কাপড়ই নয়, এ শিল্পের সাথে জড়িয়ে রয়েছে এই উপমহাদেশের আন্দোলন সংগ্রামের ইতিহাস। কুমিল্লার খাদি কাপড়ের জনপ্রিয়তার একমাত্র কারণ মহাত্মা গান্ধী। ১৯২০ সালে ইংরেজদের বিরুদ্ধে স্বদেশি আন্দোলনের ডাক দেয়ার পর এর অংশ হিসেবে তিনি বিদেশি কাপড় বর্জন করে সকলকে দেশীয় কাপড় ব্যবহারে উদ্বুদ্ধ করতে শুরু করেন। দেশীয় কাপড়গুলো সে সময় চরকায় কাটা সুতা দিয়ে তাঁতে তৈরি হত।
১৯২১ সালে মহাত্মা গান্ধীর আহবানে সমগ্র ভারতবর্ষে অসহযোগ আন্দোলনের সময় তাঁরই আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে কুমিল্লায় খদ্দরশিল্প প্রতিষ্ঠা লাভ করে। ১৯২১ সালে মহাত্মা গান্ধী কুমিল্লার চান্দিনা উপজেলায় আসেন স্থানীয় তাঁতিদের অনুপ্রাণিত করার জন্য। সে সময়’ নিখিল ভারত তন্তুরাই সমিতির’ একটা শাখা প্রতিষ্ঠা করা হয়, যা কুমিল্লা জেলায় তৈরি খাদি রপ্তানি করতে বিশেষ ভূমিকা পালন করেছিল। যার ফলে খাদির চাহিদা বেড়ে যায় কয়েকগুণ। খাদিশিল্পের প্রসারতার ২৬ বছরের মাথায় হঠাৎ থমকে দাঁড়ায় এ পণ্যটির চাহিদা। ১৯৪৭ সালে ভারত বিভক্তির সময়ে ওই সমিতি কুমিল্লা শাখা থেকে তাঁদের পৃষ্ঠপোষকতা প্রত্যাহার করলে খাদিশিল্পে বিপর্যয় নেমে আসে। তবে খাদিশিল্পের এ বিপর্যয় বেশি দিন স্থায়ী থাকেনি।
১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনের পর সমবায় আন্দোলনের প্রাণপুরুষ ড. আখতার হামিদ খানের সার্বিক চেষ্টায় এবং তৎকালীন গভর্ণর ফিরোজ খান নুনের সহযোগিতায় কুমিল্লার অভয়াশ্রমে দি খাদি এন্ড কটেজ ইন্ডাষ্ট্রিজ এসোসিয়েশন প্রতিষ্ঠিত হয়।সে সময় কুমিল্লার অভয়াশ্রম, চট্টগ্রামের প্রর্বতক সংঘ এবং নোয়াখালী গান্ধী আশ্রমে খাদি কাপড় বুনা হতো। চান্দিনাতে ড. আখতার হামিদ খান প্রতিষ্ঠিত দ্য খাদি কো-অপারেটিভ এসোসিয়েশন লিমিটেডের হাল ধরেন চান্দিনার শৈলেন গুহ ও তার ছেলে বিজন গুহ। বাবার মৃত্যুর পরে ছেলেই খাদি শিল্পকে আকড়ে রেখেছেন। চান্দিনায় এখনও মহাত্মা গান্ধীর স্মৃতি বিজড়িত তাঁতশিল্প রয়েছে।
বর্তমানে কুমিল্লার দেবিদ্বার, মুরাদনগর ও চান্দিনায় সবচেয়ে বেশি খাদি বুনা হয়। দেবিদ্ধারের বরকামতায় শ্রীনিবাসের ২টি, মতিলাল দেবনাথের ১টি, রনজিত দেবনাথের ৭টি ভুবন দেবনাথের ১টি, চিন্তা হরণ দেবনাথের ২টি তাঁত ছিল। বর্তমানে ভুবন দেবনাথের ১টি, রনজিত দেবনাথের ৫টি, চিন্তা হরণ দেবনাথের ২টি তাঁত রয়েছে। বাকীগুলো বন্ধ হয়ে গেছে। কারিগরদের পাশাপশি তাদের ছেলে-মেয়ে,বউরাও কাজ করে।
খাদি কাপড় তৈরির বিষয়ে সেখানকার তাঁতিদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ৬০ কেজি ওজনের একেকটি গাইট এনে ভাত বা ময়দার মার দিয়ে ১ ঘন্টা ভিজিয়ে রেখে রোদে শুকিয়ে ঝরঝরা করা হয়। তারপর আরো কয়েকেটি ধাপ পেরিয়ে গজ কাপড় উৎপাদিত হয়।
শুরুতে খাদি কাপড় ছিল মূলত সুতি, তবে দুই ধরনের খাদি কাপড় পাওয়া যায়। এরমধ্যে সুতি খাদি- সুতি সুতার উচ্ছিষ্ট থেকে তৈরি হয়। আর খাদি সিল্ক- সিল্কের উচ্ছিষ্ট থেকে তৈরি খাদি। একে এন্ডি সিল্কও বলা হয়।এগুলো ছাড়াও আরো দুই ধরনের খাদি তৈরি হয়ে থাকে। এর একটি পাতলা এবং অপরটি একটু ভারি অর্থাৎ মোটা। পাতলা খাদি কাপড় ব্যবহৃত হয় ফতুয়া, শার্ট, শাড়ি ইত্যাদি তৈরিতে এবং মোটা খাদি কাপড় ব্যবহৃত হয় পাঞ্জাবি, রুমাল, পার্স, বেডকভার, শাল, পর্দা, ইত্যাদি তৈরিতে।
এক সময় খাদি কাপড় শুধু দুই রঙ এর হত – সাদা এবং অফহোয়াইট বা ঘিয়ে রঙ। কিন্ত এখন দেশীয় পোশাক ডিজাইনারদের বদৌলতে লাল, নীল, সবুজ, অর্থাৎ সব ধরণের রং এর খাদি কাপড় পাওয়া যায়। আধুনিক যুগে খাদিশিল্পে অনেক পরির্বতন এসেছে। এখন যুগের সাথে তাল মিলিয়ে বিভিন্ন ডিজাইনের পোশাক যেমন শাড়ি, পাঞ্জাবী, শাল, থ্রি–পিস, টু-পিস, কুর্তা, শার্ট, টপস ইত্যাদি তৈরি হচ্ছে।
একই সাথে খাদির রঙেও এসেছে ভিন্নতা। বিভিন্ন ধরণের সুতার মিশ্রণে যেমনঃ সুতি, রেশম, সিল্ক, মুগ, তসর, উল ইত্যাদি দিয়ে এখন খাদি তৈরি হয়। এর ফলে ক্রেতার পছন্দ অনুযায়ি খুব সহজেই বিভিন্ন ধরনের খাদি পোশাক তৈরি করা যায়। এছাড়া ছোট ছোট উদ্যোক্তাদের মাধ্যমে খাদিতে বিভিন্ন ভেরিয়েশন তৈরি হচ্ছে যেটা ভবিষ্যতে খাদি শিল্পকে আরো সামনে এগিয়ে নিতে সাহায্য করবে।
একসময় যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, জাপান ও ইউরোপের কিছু দেশসহ প্রায় ১০টি দেশে কুমিল্লার খাদি কাপড় রপ্তানি হতো। এছাড়া বিভিন্ন দেশ থেকে ভ্রমণে আসা পর্যটক ও কুমিল্লার প্রবাসীদের পছন্দ ছিল খাদির পোশাক। নব্বইয়ের দশকের পরই রপ্তানি কমতে থাকে। খাদির পরিবর্তে অধিক লাভজনক তৈরি পোশাকের দিকে ঝুঁকতে শুরু করেন বিনোয়গকারীরা। তৈরি পোশাক শিল্পের রমরমায় মনোযোগ খুঁইয়ে বিদেশী বাজার হারায় খাদি কাপড়। বিনিয়োগ কমে যায় খাদি উৎপাদনে। বংশ পরম্পরায় খাদি শিল্পের সঙ্গে জড়িত তাঁতিরা পৃষ্ঠপোষকতা হারিয়ে, বেশি আয়ের উদ্দেশ্যে ভিন্ন পেশার দিকে ঝুঁকতে শুরু করে। একই সময়ে কাপড়ের বাজারে মোটা কাপড়ের তুলনায় চিকন কাপড়ের চাহিদা বেড়ে যাওয়াতে খাদি শিল্পের সঙ্কট আরও ঘনীভূত হয়।
জেলায় খাদি শিল্পের সঙ্গে জড়িতরা ও বিশিষ্টজনরা মনে করেন, সকলের উচিত চকচকে মানহীন বৈদেশিক কাপড় পরিহার করে দেশীয় কাঁচামালে, দেশীয় প্রযুক্তিতে তৈরী পরিবেশবান্ধব খাদি কাপড় পরিধান করা। আর এই ঐতিহ্যকে টিকিয়ে রাখতে এবং নতুন প্রজন্মের সামনে এতিহ্যের খাদিকে উপস্থাপন করাতে হলে এর সঠিক প্রচারণা প্রয়োজন। প্রচারণার মধ্যে খাদি নিয়ে মেলা, সেমিনার, শিক্ষাঙ্গনে খাদির প্রচারণা, ই-কর্মাস ক্লাবের র্কাযক্রম, কাস্টমার মিট-আপ, জাতীয় পর্যায়ে খাদির ব্যবহার ইত্যাদি উদ্যোগগুলো গুরুত্বর্পূণ ভূমিকা রাখবে।
Last Updated on May 29, 2023 11:48 am by প্রতি সময়