চর্মকার এর মানে হল চামড়াকে আকার দেয় যে ব্যক্তি। আমাদের ভৌগলিক প্রেক্ষাপটে যারা বিশেষত পশুর চামড়া দিয়ে পায়ে পরিধানযোগ্য পাদুকা বা জুতো তৈরী ও মেরামত করেন তাদেরকে চর্মকার বা মুচি বলা হয়। আমাদের দেশ এবং পাশের দেশ ভারতে অধিকাংশ দলিত সপ্রদায়ের লোকেরা মূলত এই পেশার সাথে যুক্ত থাকেন। অনেকে চর্মকারকে চামারের সাথে মিলিয়ে ফেলেন কিন্তু বাস্তবে দুইটি ভিন্ন দুটি পেশা।
চর্মকারের কাজ হলো জুতো মেরামত/তৈরী করা অন্যদিকে চামারের কাজ হলো পশুর চামড়া যোগাড় করে তা সংরক্ষণ করা।দুইটি সম্পূর্ণ ভিন্ন দুইটি পেশা। অনেকে আবার মুচি,চামার শব্দগুলোকে তিরস্কারমূলক শব্দ হিসেবে ব্যবহার করেন যা এই পেশার পরিপ্রেক্ষিতে খুবই অবমাননাকর ও নিন্দনীয়।
একজন চাকরি প্রত্যাশী বেকার যুবক কিংবা কোন নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের কর্তা হয়তো এই চর্মকারের প্রয়োজনীয়তা সবচেয়ে ভালো উপলব্ধি করে থাকেন। জরুরী কোন কাজে বের হলেন আর জুতো ছিড়ে গেল কিংবা চাকরির ইন্টারভিউ দিতে যাবেন জুতোজোড়া চকচকে করতে হবে- এইসব সমস্যার সমাধান একজন চর্মকার ই দিতে পারেন।
মুচির কাছে সাধারণত থাকে কালো রঙের একটি কাঠের বাক্স।বাক্সটির ভেতরের অংশ তিন ভাগে ভাগ করা। ওপরের সারিতে ডান দিকে চামড়া, বহু ব্যবহারে ক্ষয়ে আসা কাঠের আয়তাকার ছোট তক্তা। নিচের সারিতে বাঁ দিকে রাখা পেরেক, সুতা, সুচ, চিমটে ও ছুরি। জুতায় ব্যবহার করার জন্য কৌটায় রং। বাক্সের একটি অংশে আছে চামড়ার কাজ করার জন্য যাবতীয় সরঞ্জাম। তারা বাক্সটি রাস্তার পাশে রেখে ওপরে সরঞ্জামগুলো সাজিয়ে রাখে।
আবার কখনো কাঁধে নিয়ে ছুটে চলে অলিগলিতে। বর্তমানে রাস্তার ধারে অসংখ্য মুচির সন্ধান মেলে। যারা প্রতিদিন ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা আয় করে জীবিকা নির্বাহ করে।
শতবছরের ঐতিহ্যের নগরী, ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের সূতিকাগার কুমিল্লা নগরীর টাউন হল ময়দানের আশে পাশে দেখা মেলে চর্মকারের। ব্যস্ত নগরীর ব্যস্ত সড়কের ধার ঘেষে এক মনে তারা জুতো মেরামত করে যান।
একসময় মানুষের মাঝে চামড়া জুতো পড়ার চল ছিল খুব, তখন তাদের ব্যবসাও ছিল কিছুটা রমরমা। কিন্তু কালের পরিক্রমায় চামড়ার জায়গা দখল করে নিচ্ছে কৃত্রিম ফাইবারের ও রাবারের সমন্বয়ে তৈরীকৃত সিনথেটিক লেদারের নিম্নমানের বিদেশী জুতো।
দেশে চামড়ার দাম অবিশ্বাস্যরকমের সস্তা হওয়ার পরও কোন অদৃশ্য সিন্ডিকেটের কারসাজিতে চামড়ার জুতোর দাম আকাশচুম্বী। যার দরূণ দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির এই বাজারে সাধারণ মানুষ অর্থ সাশ্রয়ের নিমিত্তে এইসব মানহীন জুতো
ব্যবহারে বাধ্য হচ্ছেন। এতে যেমন দেশীয় পাদুকা শিল্পের ক্ষতি হচ্ছে ঠিক তেমনি অপচয় হচ্ছে বৈদেশিক মুদ্রার মজুতও। যার সরাসরি ভুক্তভোগী সুবিধা বঞ্চিত এই চর্মকার পেশাজীবীরা।
এই পেশায় নিয়োজিত প্রবীণ কিছু চর্মকারকে তাদের বর্তমান অবস্থা জিজ্ঞেস করতেই তাদের গম্ভীর মুখখানি বিষণ্ণ হয়ে যায়। তাদের মধ্যে জনৈক প্রহ্লাদ বাবু (৬২) জানান, ‘আগে প্রতিদিনভর কাম করতাম। পোলা মাইয়া লইয়া দুইডা ভালো মন্দ খাওয়ার সাহস করতে পারতাম। কিন্তুক এহন দুই – চারশ টাকা নিয়াও ঘরে যাইতে পারি না। বাজার সদাইয়ের যে দাম, এ রোজগার দিয়ে সংসারের খরচ কুলায় না’।
তারা তেমন শিক্ষিতও নন, গুছিয়ে কথাও বলতে পারেন না। তাদের দুঃখের কথা শুনতে কারো আগ্রহ কিংবা সময় কোনটাই হয় না। তাই হয়তো তারা এ সমাজের সাথে অভিমান করে নিজের মত করে চুপ থাকেন এই চরম দুর্দশাকে নিজেদের সবসময়ের সঙ্গী ভেবে।একই অবস্থা পুরো বাংলাদেশ জুড়েই।
অ্যামেরিকার বিখ্যাত সাবেক রাষ্ট্রপতি আব্রাহাম লিংকনের নাম কে না জানেন? কিন্তু এটা জানেন কি যে তার পিতা একজন মুচি ছিলেন? সুতরাং বৈষম্য ভুলে আমাদের উচিত সবাই যেন সমান সুযোগ পায় সেই ব্যাপারে সচেষ্ট হওয়া, সবার সমান অধিকার নিশ্চিত করা।
স্মার্টফোন আর উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করলেই আমরা আধুনিক হয়ে যাচ্ছি ব্যাপারটা এমন নয়। আমাদের মানসিকতা উন্নত করতে হবে এবং তা চর্চা করতে হবে।
সরকার এবং সংশ্লিষ্টরা চরম অবহেলিত ও উপেক্ষিত এই চর্মকার সম্প্রদায়ের পাশে দাঁড়াতে পারে। দেশের নাগরিক ও বিপন্ন এ পেশার পেশাজীবী হিসেবে তাদের জনয় কর্মভাতা ও আনুষঙ্গিক পদক্ষেপ গ্রহণ করা যেতে পারে। যাতে করে পিছিয়ে পড়া এ সম্প্রদায় দেশের সার্বিক উন্নয়নের সুবিধা ভোগ করতে পারেন। শিক্ষার আলোয় আলোকিত হয় এবং দেশের বৃহত্তর স্বার্থে নিজ নিজ অবস্থান থেকে অবদান রাখতে পারেন।
Last Updated on July 22, 2023 3:09 pm by প্রতি সময়