সাত মাসের বেশি সময় বন্ধ থাকায় ঝোপঝাড় গজে উঠেছে কিন্ডারগার্টেন স্কুলে #
কোভিড-১৯ সংক্রমণ প্রতিরোধে সাত মাসেরও বেশি সময় দেশের সরকারি বেসরকারি সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ রয়েছে। সারা দেশের মতো কুমিল্লার প্রায় দুই হাজার কিন্ডারগার্টেন স্কুল বন্ধ রয়েছে। এতে বেকার হয়ে পড়েছেন জেলার প্রায় ২৫ হাজার শিক্ষক, কর্মচারী। স্কুল বন্ধ থাকায় প্রায় সাত মাস ধরে বেতনও পাচ্ছেন না তারা।এ ছাড়াও এসব স্কুলের অনেক শিক্ষকদের প্রাইভেট টিউশনিও করোনার কারণে বন্ধ রয়েছে। স্কুলের স্বল্প বেতন ও প্রাইভেট টিউশনির টাকা দিয়ে কোনরকম জীবিকা নির্বাহ করতেন শিক্ষকরা। কিন্ডারগার্টেন বন্ধ থাকায় আয়ের পথও বন্ধ হয়ে যাওয়ায় অর্থাভাবে অনেকটাই মানবেতর জীবনযাপন করছেন এসব শিক্ষক-কর্মচারী।
সরজমিনে কিছু স্কুলে গিয়ে দেখা গেছে, শিক্ষার্থীদের পদাচরণ না থাকায় বিদ্যালয় মাঠে ঘাস বড় হয়ে ঝোপঝাড় সৃষ্টি করেছে। অনেক বিদ্যালয়ে ভূতুড়ে পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। আবার ভাড়া বাড়িতে থাকা অনেক কিন্ডার গার্টেন স্কুল স্থায়ীভাবে বন্ধ হয়ে গেছে। অপরদিকে যারা এসব কিন্ডারগার্টেন স্কুলের বেতনের উপর নির্ভরশীল ছিলেন, তারা পড়েছেন বিপাকে। এরই মধ্যে অনেকে চাকরি ছেড়ে অন্য পেশায় যুক্ত হয়েছেন। আবার কেউ কেউ জীবিকার পথ খুঁজছেন। অনেক কিন্ডার গার্টেন স্কুলের অফিস সহকারি, দাড়োয়ান, নাইটগার্ড, আয়া, ঝাড়ুদার অন্য পেশায় যেুক্ত হয়েছেন।
শিক্ষকরা বলছেন, আগামী ১৪ নভেম্বর পর্যন্ত সরকারি নির্দেশনা থাকায় বিদ্যালয়গুলো খোলা সম্ভব হচ্ছে না। এতে অভিভাবকরা তাদের সন্তানদের বেতন বন্ধ করে দিয়েছেন। বিদ্যালয়গুলোর এ বছর না খুললে আগামী বছর থেকে অনেক কিন্ডার গার্টেন স্কুল স্থায়ীভাবে বন্ধ হয়ে যেতে পারে। তাদের দাবি সরকারি প্রনোদনা নয়, হেফজখানা ও কওমি মাদ্রাসার মতো কিন্ডার গার্টেন স্কুলগুলো স্বাস্থ্যবিধি মেনে খুলে দেওয়া হউক।
নগরীর শাসনগাছা এলাকার একটি কিন্ডারগার্টেন স্কুলে শিক্ষকতা করে সংসার চালাচ্ছিলেন আজাদ নামের এক শিক্ষক। স্কুলের বেতনের পাশাপাশি সংসারের ব্যয় মেটাতে অতিরিক্ত সময় শিক্ষার্থীদের প্রাইভেট পড়িয়ে চলত তার সংসার। কিন্তু করোনার কারণে গত প্রায় সাত মাস ধরে স্কুলের বেতন বন্ধ। নেই সরকারি সহায়তা। এতে কষ্টে কাটছে তার জীবন। বর্তমানে তিনি বাসায় বাসায় ঘুরে দুধ সরবরাহ করে জীবিকা নির্বাহ করছেন।
আজাদ জানান, ৫০টাকা কেজি দরে দুধ কিনেন বিক্রি করেন ৬০ টাকা কেজি দরে। ঘাটতি যাতায়াত খরচ বাদ দিয়ে কেজিতে ৫-৬ টাকা থাকে। দৈনিক গড়ে ৪০-৫০ কেজি দুধের চাহিদা রয়েছে। অপরদিকে বুড়িচং উপজেলার একটি কিন্ডার গার্টেন স্কুল শিক্ষক রবিউল । তিনি নতুন পেশা বেছে নিয়েছেন রং মিস্ক্রি কাজ। রবিউল বলেন, স্কুলের বেতন আর শিক্ষার্থীদের প্রাইভেট পড়ে সংসার চলত। কিন্তু গত ছয়মাস বেতন বন্ধ, বন্ধু-বান্ধব আত্মীয় স্বজনদের কাছ থেকে ধার-দেনা করে সংসার চালিয়েছি। দোকানেও অনেক বাকি পড়ায় দোকান মালিকও কথা শোনায়। তিনি বলেন, সংসারে কষ্ট ছিল। কিন্তু এমন সমস্যায় পড়তে হবে ভাবতেও পারিনি। তাই বর্তমানে বিভিন্ন স্থানে রংমিস্ত্রীর কাজ করছি।
এভাবে আজাদ রবিউলের মতো অনেকেই শিক্ষকতা ছেড়ে অন্য পেশায় চলে যাচ্ছেন।পরিস্থিতির উন্নতি ঘটলে এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুললে আবার ফিরে যাবেন আগের পেশায়। এমনটিই জানালেন অনেকে।
মানবেতর জীবনের মুখোমুখি এসব শিক্ষকরা বললেন-এই দু:সময়ে পাশে নেই কিন্ডার গার্টেন এসোশিয়েশনের নেতৃবৃন্দ। তাদের যুক্তি এসোশিয়েশনের নেতৃত্বে আন্দোলন গড়ে তুলতে পারলে হয়ত সরকার কওমি মাদরাসার মতো কিন্ডার গার্টেন স্কুলগুলো স্বাস্থ্যবিধি মেনে খোলার অনুমতি পেত অথবা সরকারি প্রনোদনা আদায় করা যেত। সদর উপজেলার কালিরবাজার এলাকার বিলকিস আক্তার নামের এক কিন্ডার গার্টেন শিক্ষিকা জানান, যদি এসোশিয়েশন আন্তরিক হতো তাহলে সরকারের কাছে আমাদের যৌক্তিক দাবিগুলো তুলে ধরতে পারতেন। অনেক পেশার মানুষ সরকারি প্রনোদনা পেলেও বঞ্চিত হয়েছে কিন্ডার গার্টেন শিক্ষকরা। আমরা এখন প্রনোদনা চাই না,স্বাস্থ্যবিধি মেনে কিন্ডারগার্টেন খোলার অনুমতি চাই।
কমলাপুর চাইল্ড হেভেন স্কুলের প্রধান শিক্ষক আবদুর রহিম বলেন,করোনা সংকটের প্রথম দিকে রমজানের ঈদকে সামনে রেখে মফিজুল ইসলাম রিপন নামে এক সৌদি প্রবাসী ব্যাবসায়ী শিক্ষক ও কর্মহীন শিক্ষকদের জন্য খাদ্য সহায়তা প্রদান করেছেন। আর স্কুলের ফান্ড থেকে দুই মাস বেতন দেওয়ার পর আর্থিক সংকটের ফলে শিক্ষকদের বেতন দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। আর স্কুল খুললেও সব শিক্ষার্থী ফিরবে কিনা এ নিয়ে সন্দিহান তিনি। কারণ ইতিমধ্যে অনেক অভিভাবক কর্মহীন হয়ে আর্থিক সংকটে পড়েছেন। তারা বিনাবেতনে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের দিকে তাদের সন্তানদের ভর্তি করাতে পারেন বলে মনে হচ্ছে।
কুমিল্লা জেলা কিন্ডার গার্টেন এসোশিয়েশনের সাধারণ সভায় বক্তব্য রাখেন অধ্যক্ষ শামীম হায়দার। ফাইলফটো #
কুমিল্লায় কিন্ডারগার্টেন ঘরণার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেগুলোর অবিভাবক সংগঠন হচ্ছে কুমিল্লা জেলা কিন্ডার গার্টেন এসোশিয়েশন। কিন্ডার গার্টেন শিক্ষকদের এ সংগঠনে প্রায় দেড়শতাধিক প্রতিষ্ঠান অন্তর্ভূক্ত রয়েছে। কুমিল্লা জেলা কিন্ডারগার্টেন এসোসিয়েশনে সাধারন সম্পাদক অধ্যক্ষ মোহাম্মদ শামীম হায়দার জানান, কুমিল্লার কিন্ডার গার্টেন স্কুলের শিক্ষকরা কষ্টে দিন কাটাচ্ছেন। বেশির ভাগ স্কুলগুলোতে শিক্ষক-কর্মচারিরা বেতন পাচ্ছেন না। তারা সবাই বিপাকে পড়েছেন। শিক্ষকদের পাশাপাশি বাসা ভাড়া বা জায়গা ভাড়া নিয়ে গড়ে তোলা কিন্ডার গার্টেনের মালিকরাও বেকায়দায় রয়েছেন। মার্চ মাস থেকে দেশের সকল কিন্ডারগার্টেন স্কুলগুলো বন্ধ থাকায় অভিভাবকদের কাছ থেকে বেতন আদায় করা সম্ভব হয়নি। কিন্তু বিদ্যালয়গুলো ঘরভাড়া নিয়মিত পরিশোধ করতে হচ্ছে। অনেক কিন্ডারগার্টেন কর্তৃপক্ষ তাদের প্রতিষ্ঠানের ভাড়া, বিদ্যুত বিল বকেয়া থাকায় প্রতিষ্ঠান টিকিয়ে রাখতে পারবেন কিনা সেই শঙ্কায় রয়েছেন।
কিন্ডার গার্টেন এসোশিয়েশন শিক্ষকদের দুর্দিনে পাশে নেই এমন প্রশ্নের জবাবে সংগঠনটির সাধারণ সম্পাদক বলেন, আমাদের এসোশিয়েশনের মূল কাজ বৃত্তি পরীক্ষা নিয়ে যথাযথ মূল্যায়নের মাধ্যেমে বৃত্তি প্রদান করা। এত বিপুল সংখ্যক শিক্ষককে প্রনোদনা দেওয়ার আর্থিক সামর্থ আমাদের নেই।
উল্লেখ্য,কুমিল্লা জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিস সূত্রে জানা গেছে,২০১৯ সাল পর্যন্ত কুমিল্লা জেলার কিন্ডার গার্টেন বেসরকারী স্কুলের সংখ্যা ছিল ১৭৮১টি। এছাড়া সরকারি তালিকাভুক্তি ছাড়াও কিছু স্কুল রয়েছে। সব মিলিয়ে দুই হাজারের মতো প্রতিষ্ঠান রয়েছে কুমিল্লায়। যেখানে শিক্ষক ও কর্মচারির সংখ্যা প্রায় ২৫ হাজার হবে।
# দেশ-বিদেশের গুরুত্বপূর্ণ খবর জানতে প্রতিসময় (protisomoy) ফেসবুক পেইজে লাইক দিন। এছাড়া protisomoy news ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন ও বেলবাটন ক্লিক করে নতুন নতুন নিউজ পেতে অ্যাকটিভ থাকুন।
Last Updated on November 3, 2020 4:46 pm by প্রতি সময়