শুক্রবারের ইসলামিক প্রতিবেদন
পবিত্র হজ্বকে কেন্দ্র করে মুসলিম বিশ্বের সর্ববৃহৎ সমাবেশ ঘটে মক্কা নগরে। সারা বিশ্বের,নানা বর্ণের লক্ষ লক্ষ (সামর্থ্যবান) মানুষের হজ্ব আদায় তথা মহান আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টি অর্জন শেষ করে নিজ নিজ দেশ ও আপনজনদের কাছে আসা শুরু হয়ে গেছে। ইসলামে মানব জীবনের মতো ইবাদতেও দেহ-প্রাণ আছে। জাহেরি আকৃতির সঙ্গে আছে বাতেনি শক্তি।বাহ্যিকতা ছাপিয়ে আধ্যাত্মিক ও অভ্যন্তরীণ প্রাণ শক্তিই ইবাদতের অন্যতম শর্ত।
নামাজ, রোজা, হজ্ব , জাকাত, কোরবানিসহ ইসলামের প্রতিটি ইবাদতের বাহ্যিক আচরণের পাশাপাশি রয়েছে অন্তর্নিহিত দর্শন। ধনবান, সচ্ছল ও শারীরিকভাবে সামর্থ্যবান ব্যক্তিদের জন্য জীবনে একবার হজ্ব করা ফরজ। পৃথিবীর নানা প্রান্ত থেকে লাখ লাখ টাকা খরচ করে যে হজ্ব পালন করা হয়, তা কেবল ভ্রমণেই শেষ হয়ে যায় না।
পবিত্র কোরআন বিষয়টি স্পষ্ট করে দিয়েছে যে হজ্বের উদ্দেশ্য হলো আখিরাতের পাথেয় সঞ্চয় করা। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘নির্দিষ্ট মাসে (শাওয়াল, জিলকদ ও জিলহজ্বে) হজ্ব অনুষ্ঠিত হয়। অতএব, এই মাসগুলোতে যার ওপর হজ্ব ফরজ হয়, সে যেন (হজ্বে গিয়ে) স্ত্রী সম্ভোগ, অনাচার ও ঝগড়া-বিবাদে লিপ্ত না হয়। তোমরা যেসব সৎ কাজ করো, আল্লাহ তা জানেন। আর (পরকালের) পাথেয় সংগ্রহ করো, নিশ্চয়ই তাকওয়া বা আত্মসংযমই হলো শ্রেষ্ঠ পাথেয়।’ (সুরা : বাকারা, আয়াত : ১৯৭)
হজ্ব হলো তাওহিদ তথা আল্লাহর নিরঙ্কুশ একত্ববাদের আলোকে জীবন প্রতিষ্ঠার অন্যতম সহায়ক। কাজেই হজ্ব থেকে ফিরতে হবে তাওহিদের দীক্ষা নিয়ে। মহান আল্লাহ বলেন, ‘আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের পক্ষ থেকে মহান হজ্বের দিনে মানুষের প্রতি (বিশেষ) বার্তা হলো, আল্লাহর সঙ্গে অংশীবাদীদের কোনো সম্পর্ক নেই এবং তাঁর রাসুলের সঙ্গেও নেই।’ (সুরা : তাওবা, আয়াত : ৩)
হজ্ব কবুল হওয়ার নিদর্শন হলো, এর ফলে জীবনের মোড় ঘুরে যায়।ভবিষ্যতে গুনাহ থেকে বিরত থাকার আগ্রহ বাড়ে। আল্লাহর আনুগত্যের প্রতি মানুষ যত্নবান হয়। হজ্ব করার পর যাঁর জীবনে কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তন আসেনি, তাঁর হজ্ব কবুল হওয়ার বিষয়টি সন্দেহমুক্ত নয়।
মনীষীদের একটি বহুল আলোচিত বাণী , ‘নেক কাজের প্রতিদান হলো এর পরেও নেক কাজের ধারাবাহিকতা বজায় রাখা, আর পাপ কাজের প্রতিদান হলো, এর পরেও পাপ কাজ অব্যাহত করে যাওয়া।’ বাংলাদেশ থেকে প্রতিবছর লক্ষাধিক ধর্মপ্রাণ মুসলমান হজ্বে যান। কিন্তু কয়জনই বা নিষ্পাপ হয়ে ফিরতে পারেন? সমাজের অনাচার কি কমছে? দেশ ও সমাজ তাঁদের মাধ্যমে যথাযথভাবে উপকৃত হতে পারছে কি? মক্কা-মদিনার জিয়ারত তাঁদের মধ্যে কি হানিমুন, শপিং, পর্যটন ও প্রমোদ ভ্রমণ উপলক্ষে দেশ-দেশান্তরে ছুটে চলার চেয়ে ভিন্ন কোনো অনুভূতি জাগ্রত করতে পেরেছে? যদি উত্তর নেতিবাচক হয়, তাহলে তাঁরা কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত হয়েছেন। তাঁদের হজ্ব কবুল হওয়ার বিষয়টি সন্দেহমুক্ত নয়।
হজ্ব থেকে ফিরে এসে নিকটস্থ মসজিদে দুই রাকাত নামাজ আদায় করা সুন্নাত। হযরত কাব বিন মালেক (রা.) থেকে বর্ণিত, ‘রাসুলুল্লাহ (সা.) যখন কোনো সফর থেকে ফিরে আসতেন, তখন মসজিদে (নফল) নামাজ আদায় করতেন।’ (বুখারি শরিফ)
হজ্ব থেকে ফিরে শুকরিয়া স্বরূপ গরিব-মিসকিন ও আত্মীয় স্বজনকে খাবারের দাওয়াত দেওয়া বৈধ। ইসলামী ফিকহের পরিভাষায় সে খাবারকে ‘নকিয়াহ’ বলা হয়। হযরত জাবের বিন আবদুল্লাহ (রা.) থেকে বর্ণিত, ‘রাসুল (সা.) যখন মদিনায় এসেছেন, তখন একটি গরু জবাইয়ের নির্দেশ দেন। জবাইয়ের পর সাহাবিরা তা থেকে আহার করেছেন।’ (বুখারি)
তবে অহংকার, লোক দেখানো ও বিশেষ উদ্দেশ্য সামনে রেখে এমন দাওয়াতের ব্যবস্থা করা ইসলাম অনুমোদন করে না। (ফতোয়ায়ে মাহমুদিয়া ৭/১৮৫)
ঘরে ফিরে দুই রাকাত নামাজ আদায় করা মুস্তাহাব। হাদিস শরিফে এসেছে, ‘যখন তুমি ঘর থেকে বের হবে, তখন দুই রাকাত নামাজ পড়বে। সেই নামাজ তোমাকে ঘরের বাইরের বিপদাপদ থেকে হেফাজত করবে। আর যখন ঘরে ফিরবে, তখনো দুই রাকাত নামাজ আদায় করবে। সেই নামাজ তোমাকে ঘরের অভ্যন্তরীণ বালা-মুসিবত থেকে হেফাজত করবে।’ (মুসনাদ)
হাজি সাহেবদের অভ্যর্থনা ও শুভেচ্ছা জানানো, তাঁদের সঙ্গে সাক্ষাৎ, মুসাফাহ, কোলাকুলি করা এবং তাঁদের দিয়ে দোয়া করানো মুস্তাহাব।
জমজমের পানি অন্য শহরে নিয়ে গিয়ে লোকদের পান করানো মুস্তাহাব। অসুস্থ রোগীদের গায়ে ব্যবহার করাও বৈধ। (মুয়াল্লিমুল হুজ্জাজ : ৩০৩) আয়েশা (রা.) জমজমের পানি সঙ্গে করে নিয়ে যেতেন এবং বলতেন, ‘রাসুল (সা.) জমজমের পানি সঙ্গে নিয়ে যেতেন।’ (তিরমিজি : ১১৫)
আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধবকে হাদিয়া-তোহফা দেওয়া সুন্নাত। কিন্তু মনের আগ্রহ ছাড়া কেবল প্রথা পালনের জন্য কোনো কাজ করা শরিয়তসম্মত নয়। হাজিদের হাদিয়া দেওয়া এবং তাঁদের কাছ থেকে হাদিয়া গ্রহণ করা এখন প্রথায় পরিণত হয়েছে। বর্তমানে এটা নামের জন্য বা চক্ষু লজ্জার কারণে দেওয়া হয়। তাই তা বর্জন করা উচিত। (আপকে মাসায়েল : ৪/১৬১)।
মহান আল্লাহ তায়ালার আদেশ/বিধানের আলোকে এবং ইসলামের প্রকৃত পথ ও মতে থেকে হজ্ব পরবর্তী জীবন পরিচালনা করা একজন হজ্ব পালনকারি মানুষের দায়িত্ব। আমিন।
Last Updated on July 7, 2023 12:12 pm by প্রতি সময়