ছবি: জেলা লিগ্যাল এইড অফিসার সিনিয়র সহকারী জজ ফারহানা লোকমানের সাথে শিশু তাহমিনা #
কুমিল্লায় বিনামূল্যে অসহায় মানুষদের আইনী সেবা দিয়ে দিন দিন জনপ্রিয় হয়ে উঠছে আইনমন্ত্রণালয়ের অধীনে থাকা সরকারি আইনগত প্রদান সংস্থা জেলা লিগ্যাল এইড অফিস।চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিষ্ট্রেট ভবনের তৃতীয় তলায় অবস্থিত জেলা লিগ্যাল এইড অফিসটিতে যোগাযোগ করে বিচারপ্রার্থী অসহায় দরিদ্র নারী-পুরুষ আইনী সহায়তা পেয়ে ঘুরে দাঁড়ানোর সুযোগ পাচ্ছেন।অসহায় নারীরা পুনর্বাসিত হয়ে ফিরে পাচ্ছেন তাদের সুখের দাম্পত্য জীবন ও সংসার, সন্তান ফিরে পাচ্ছে বাবা অথবা মাকে।আবার জমিজমা সংক্রান্ত বিষয়েও নিষ্পত্তির মাধ্যমে উপকৃত হচ্ছেন ক্ষতিগ্রস্ত পক্ষ। এমনিভাবে কুমিল্লা জেলায় হাজার হাজার অসহায় ও দরিদ্র মানুষকে বিনামুল্যে আইনী সহায়তা দিয়ে ভাগ্য বদলের কাজ করছেন জেলা লিগ্যাল এইড অফিসের অফিসার ও কর্মীরা।অনলাইন নিউজপোর্টাল ‘প্রতিসময়’ এর বিশেষ প্রতিবেদনে এখন থেকে সাদিক মামুনের রিপোর্টে নিয়মিত থাকবে কুমিল্লায় সরকারি আইনগত প্রদান সংস্থা লিগ্যাল এইড অফিসের মাধ্যমে বিনাখরচে আইনী সেবার সফলতা ও সুফল ভোগী মানুষের কথা।আজ রয়েছে শিশুকন্যা তাহমিনা দীর্ঘ দশ বছর পর জন্মদাতা পিতার মুখ প্রথম দেখল এবং তার ভরণপোষনের প্রাপ্য অধিকার প্রতিষ্ঠিত হওয়ার খবর…
শিশুর সবচেয়ে আপনজন ও নিরাপদ ঠিকানা হল মা-বাবা। সন্তানের কষ্ট, তার কী লাগবে , কী লাগবে না-এমন সব প্রয়োজন তখনই পরিপূর্ণতা পায়, যখন মা-বাবা মিলে এসব অনুভব করেন। কিন্তু মা-বাবার দ্বন্দ্বে বিচ্ছেদের ঘটনায় সন্তান হয় মা থেকে , নয়তো বাবা থেকে আলাদা হয়ে পড়ছে। তাকে হয় পিতার তত্ত্বাবধানে নয়তো মায়ের তত্ত্বাবধানে থাকতে হচ্ছে। আবার কখনো বিবাহ বিচ্ছেদের পর কোলের শিশু সন্তান বা আরও অন্যবয়সী সন্তানের ভরণপোষন, সন্তানের সার্বিক অধিকার পাওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েও অনেক পিতা সেই দায়িত্ব পালন ও প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেন না। এমনকি সন্তানের মায়াভরা মুখটাও দেখতে আসেন না।
এমনি এক পিতাকে দীর্ঘ দশ বছর পর শিশুকন্যার সামনে দাঁড় করালেন কুমিল্লা জেলা লিগ্যাল এইড অফিস। দশ বছর বয়সী তাহমিনা এই প্রথম তার বাবাকে দেখে অপুলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল। বয়স কম হলেও বাবার আদর যত্ন খেযাল থেকে দীর্ঘ দশ বছর বঞ্চিত তাহমিনা বার বার তার বাবার দিকে তাকিয়ে ভাবছে, ‘বাবা এমন কেন ? দশ বছরে একটি বারও মেয়েকে দেখার ইচ্ছে হয়নি’
শিশু তাহমিনার এমন ভাবনা আসা স্বাভাবিক। যদিও সে মুখ খুলে বলতে পারেনি। চোখের ভাষাই সেই ভাবনার জানান দিয়েছে। তবে সকল ভাবনার অবসান ঘটালেন জেলা লিগ্যাল এইড অফিস-কুমিল্লার অফিসার সিনিয়র সহকারী জজ ফারহানা লোকমান।
দশ বছর বয়সী তাহমিনা। পিতার সোহাগ আর ভালবাসা দুটো থেকেই বঞ্চিত সে। মায়ের কোল জুড়ে পৃথিবীতে ভূমিষ্ঠ হওয়ার তিনমাসের মধ্যেই তাহমিনার বাবা-মায়ের তালাকের ঘটনা ঘটে। তাহমিনার বাবা তালাকের পর সন্তানদের ভরণপোষন তো দূরের কথা- দশ বছরের মধ্যে একটি দিনই খবর নেননি ফেলে আসা তিন মাসের কন্যা সন্তানটি কেমন আছে, কেমন চলছে দিনকাল। তালাকের দুই বছরের মধ্যে মারা যায় তাহমিনার মা। এতিম এই শিশুটির ভরসাস্থল হয়ে দাঁড়ায় তার নানী।প্রথম দিকে তাহমিনার মামারা কিছু আর্থিক সহায়তা করলেও পরে তা বন্ধ হয়ে যায়।
নানী এদিক সেদিক করে তার খরচ চালায়। সে আবাসিক মাদ্রাসায় পড়াশোনা করে। যতই দিন যাচ্ছে তার খরচ বাড়ছে। এক পর্যায়ে তার খরচ চালাতে অপারগ হয়ে নানি জেলা লিগ্যাল এইড অফিস কুমিল্লার শরণাপন্ন হন। অফিস থেকে তাহমিনার বাবাকে এডিআর’র নোটিশ পাঠানো হয়। তাহমিনার বাবা হাজির হলে দশ বছর পর বাবা-মেয়ে মুখোমুখি।তাহমিনা অনেক কিছু বুঝতে শিখেছে, বুঝেও।আর তাই এই প্রথম বাবাকে দেখার পর তার চোখে পানি ছল ছল করছিল।
লিগ্যাল এইড অফিসে শিশু তাহমিনার প্রসঙ্গ নিয়ে আইনগত অনেক আলোচনাই করেন সিনিয়র সহকারী জজ ফারহানা লোকমান।পরে মধ্যস্থতার মাধ্যমে এখন থেকে তাহমিনার ভরণপোষন ঘিরে যাবতীয খরচ তার বাবা দেবেন বলে সম্মত হন। তার উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্য সম্পত্তি থেকে তাহমিনাকে কোন রূপ বঞ্চিত করবেন না এবং ভবিষ্যতে বিয়ে সাদীর খরচ দেবেন বলেও চুক্তি স্বাক্ষর করেন। নানি মারা গেলে তিনি তাহমিনার দেখাশোনার দায়িত্ব নেবেন বলেও সম্মত হন।
তাহমিনার নানী আবেগআপ্লুত হয়ে বললেন, এখানকার লিগ্যাল এইড অফিসের মাধ্যমে আইনি সহায়তায় তার নাতনি অধিকার ফিরে পেয়েছে। মা হারা এই শিশুটিকে তার দুঃখের জীবন থেকে সুখের জীবনে ফিরে আসার সুযোগ করে দিয়েছে কুমিল্লার লিগ্যাল এইড অফিস।
জেলা লিগ্যাল এইড অফিস-কুমিল্লার অফিসার সিনিয়র সহকারী জজ ফারহানা লোকমান বলেন, ‘এধরণের পারিবারিক অনেক ঘটনাই আমরা নিষ্পত্তি করে থাকি। তবে শিশু তাহমিনার ঘটনাটি বেশ কষ্টমিশ্রিত। ওর নানীর কাছে সব ঘটনা শুনে আমরা পদক্ষেপ নেই, যাতে শিশুটি তার সব অধিকার ফিরে পায়। বিষয়টি মধ্যস্থতার দিন আমি দেখেছি-তাহমিনা প্রথমবারের মতো তার বাবাকে দেখেছে। বারবার তার বাবার মুখের দিকে তাকাচ্ছিল। হয়তো ভাবছিল, বাবা কি মেয়েকে একেবারের জন্য না দেখে এতোদিন থাকতে পারে? বেশ স্থির স্বভাবের মেয়ে তাহমিনা। তার পড়াশোনা, মাদ্রাসা জীবন, নানী মামা মামীদের সাথে সম্পর্ক নিয়ে বেশ গুছিয়ে কথা বলেছে সে। জেলা লিগ্যাল এইড অফিস-কুমিল্লা শিশু তাহমিনার প্রাপ্য অধিকার বুঝে দিতে পেরেছে। লিগ্যাল এইডের মাধ্যমে অসহায় দরিদ্র বিচারপ্রার্থীরা বিনা খরচে সার্বিক ও যথাযথ আইনি সহায়তার সুফল পাচ্ছেন। লিগ্যাল এইড কার্যক্রমের সুফল সর্বত্র পৌঁছে দিতে আমরা বদ্ধপরিকর।’
# দেশ–বিদেশের গুরুত্বপূর্ণ খবর জানতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।
Last Updated on September 10, 2020 2:15 pm by প্রতি সময়