প্রায় দেড়শ বছর আগের একটি বাজার একটি জনপদের দৃশ্যপট পাল্টে দিয়েছিল। বাজারটি অসংখ্য মানুষের জীবন জীবিকা নির্বাহের অন্যতম মাধ্যমে পরিণত হয়েছিল।পাঁচ বছর আগে বাজারটি বন্ধ হয়ে যাওয়ায় এখন এটি ওই জনপদের মানুষের কাছে কেবলই ধূসর স্মৃতি।
বাজারটির অবস্থান কুমিল্লার মুরাদনগর উপজেলার আন্দিকুট ইউনিয়নের সিদ্ধিগঞ্জ বাজার। বাজারের পাশে বুড়ি নদী। নদীর ওপাড়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবা উপজেলা। বুড়ি নদীতে সকাল বিকেল একদল লোক বালু উত্তোলন করে। নৌকাতেই তারা সংসার পেতেছে। পাশে বাজার আছে। তবুও তারা বাড়ি থেকেই চাল-ডাল নিয়ে আসেন। নদীর পানিতে ধুয়ে মুছে রান্না করেন।
সরেজমিনে সিদ্ধিগঞ্জ বাজারে গিয়ে দেখা যায়, পুরো বাজারটিতে নিরবতা দখল করে আছে। শতাধিক দোকান পাট। সবকটি তালা ঝুলানো। দরজা জানালায় জং ধরে আছে। দোকানের সাইবোর্ডগুলো ক্ষয়ে যাচ্ছে। বাজারের পাশে দুটি দোকান জানান দিচ্ছিলো এক সময়ের হাকডাক দেয়া বাজারটির কথা। পাশে শান্ত শীতল জলের সেই বুড়ি নদীটিও যেন বাজারের অভাব বুকে ধারণ করে হাহাকার করছে।
মানুষের পদচারণা না থাকায় বাজারটির ভেতর ঘাস লতা পাতা জন্মেছে। বাজারের উত্তর ও পশ্চিম পাশে মসজিদ রয়েছে। মসজিদে তেমন মুসল্লি নেই। বাজারের উত্তর কোনে একটি ভবনে রয়েছে পুলিশ ফাঁড়ি।
স্থানীয়দের সাথে কথা বলে জানা যায়, বুড়ি নদীর তীরে দেড়শ’ বছর আগে বাজার বসা শুরু হয়। নদীতে নৌকা যোগে ক্রেতারা আসতেন বিভিন্ন জেলা থেকে। কুমিল্লার বিভিন্ন উপজেলা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, ভৈরব, নোয়াখালী ও চাঁদপুর থেকে আসতো পাট ও নানা পণ্য বোঝাই নৌকা। এই বাজারে বিক্রি হতো।
যে কারনে বন্ধ হয়ে গেছে সিদ্ধিগঞ্জ বাজারঃ দেড়শ বছর আগে সিদ্ধিগঞ্জ বাজারটির চালু হয়। ওই সময় নদীপথে কুমিল্লা ব্রাহ্মনবাড়ীয়া, নোয়াখালী ও চাঁদপুরের মানুষজন আসতো। নৌকা বোঝাই শাক সবজি মাছ, দুধ কলা ও শাড়ি কাপড় নিয়ে আসতেন। ভোর রাত থেকে বাজারটি শুরু হতো। বিয়ে শাদীর প্রয়োজনীয় পন্যসহ দৈনিন্দিন কাজে ব্যবহার এমন সবকিছুই পাওয়া যেতো বাজারটিতে।
কালের বির্বতনে কুমিল্লা নোয়াখালী ব্রাহ্মনবাড়িয়ার বিভিন্ন উপজেলায় ছোট ছোট হাট বাজার শুরু হয়। সড়ক পথে যাতায়াত বৃদ্ধি পায়। সময় বাঁচে। তাই শুধু নৌপথে সদাই বিক্রি করতে হয় বলে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন বিক্রেতারা। এভাবে আস্তে আস্তে বন্ধ হয়ে যায় সিদ্ধিগঞ্জ বাজারটি। ক্রেতা বিক্রেতার অভাবে জৌলুস হারিয়ে বাজারটি এখন ভৌতিক পরিবেশ ধারণ করে আছে।
স্থানীয়রা যা বলেনঃ সিদ্ধিরগঞ্জ বাজারের পাশের গ্রাম সোনারামপুর। ওই গ্রামের বাসিন্দা আহসান হাবীব বলেন, ছোট বেলায় বাবার হাত ধরে বাজারে আসতাম। লেখাপড়ার খরচ জোগাতে নিজের জমির শাক সবজি বিক্রি করেছি। কত জমজমাট ছিলো বাজারটি। পড়ে লেখাপড়ার জন্য ঢাকায় চলে যাই। লেখাপড়া শেষে চাকুরী সংসার নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ি। গত ঈদে বাড়ি আসি। বন্ধুদের নিয়ে হাটতে হাটতে বাজারটিতে যাই। বাজারটিতে জরার্ণ দোকানপাট দেখে বুকের ভেতর হাহাকার করে উঠে। নেই বাজারটির সেই আগের রুপ। সময়ের আর্বতে কিভাবে হারিয়ে গেলো আমাদের শৈশব কৈশোরের বাজারটি।
বাজারটির পাশের গ্রাম ডালপা। ওই গ্রামের বাসিন্দা প্রকৌশলী মনিরুল ইসলাম বলেন, কার্গো দিয়ে বাজারটিতে মালামাল আসতো। ১৯৮৭ সালে একবার বাজারটিতে ডাকাতির ঘটনা ঘটে। স সময় ডাকাতির ঘটনায় ক্রেতা বিক্রেতাদের মধ্যে আতংক ছড়িয়ে পড়ে। পরে বছর বাজারের উত্তরপাশে একটি পুলিশ ফাঁড়ি করা হয়। পুলিশ ফাঁড়িটি করার জন্য সবচেয় বড় ভ‚মিকা রেখেছেন কুমিল্লা উত্তরজেলা আওয়ামীলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক বর্ষীয়ান আওয়ামীলীগ নেতা জাহাঙ্গীর আলম সরকার।
গাঙ্গেরকুট এলাকার সাবেক ইউপি সদস্য মোঃ ফাতু মিয়া ভারাক্রান্ত মনে বলেণন, এখন এই বাজারে আসলে মন খারাপ হয়ে যায়। ৫০ বছরের বেশি সময় ধরে এখানে বাজার করতাম। গাছের তলে বসতো ১২ জনের বেশি নাপিত। এই বাজারে পাশের গ্রামের ঘোষ সম্প্রদায়ের লোকজন জিলাপি মিষ্টি বানাতো। কেমন স্বাদ লাগতো। আক্ষেপ করে ফাতু মিয়া বলেন আবার কি বাজারটি জমজমাট হবে। মরার আগে যদি বাজারটির পুরনো রুপটা দেখে যেতে পারতাম।
চা দোকানি আন্দিকুট গ্রামের বাসিন্দা শামছুল হক বলেন, ৫০বছর ধরে এখানে চা বিস্কিট বিক্রি করি। নৌকা দিয়ে যারা বালু তুলে তারা মাঝে মধ্যে আসে। বিড়ি সিগারেট কিনে । তাদের সাথে কথা বলি। এই প্রতিবেদকের কাছে শামছুল আলম প্রশ্ন রেখে বলেন বাজান বাজারটি কি আর চালু হবে না।
ভুতুরে পরিবেশ হলেও বাজারটির চারপাশে নদী দিগন্ত বিস্তৃস্ত সবুজ ধানী। নদীতে দেখা যায় নৌকার সারি। গরুর পাল চড়ে, বক সারস ডাহুকসহ নাম না জানা পাখিদের উড়াউড়িতে মন ভরে যায়। বাজারটি দেখতে দূরদুরান্ত থেকে ভ্রমন পিয়াসীরা আসেন। বুড়ি নদীর রুপ সৌন্দর্য্য দেখে বাজারে প্রবেশ করতেই মন খারাপ হয়ে যায় কুমিল্লা ওয়াইডাব্লিউসিএ এর সাধারণ সম্পাদিকা আইরিন মুক্তা অধিকারী। পরিবার নিয়ে বাজার, বুড়িনদী ঘুরে বলেন, এখানে একটি পর্যটন কেন্দ্র হতে পারে। সবুজ প্রকৃতি আচ্ছাদিত করে রেখেছে চারপাশ। কর্তপক্ষ একটু নজর দিলেই এই স্থানটি নান্দনিক হয়ে উঠতে পারে ।
মুরাদনগর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আলাউদ্দীন ভূঞা জনী বলেন, স্থানীয়দের আগ্রহ থাকলে একটি বাজার জমে উঠে। আবার তারা না আসলে সেটা বন্ধ হয়ে যায়। সিদ্ধিগঞ্জ বাজার পরিদর্শন করবো। সড়ক সংস্কারসহ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবো।
Last Updated on October 4, 2022 8:22 pm by প্রতি সময়