নেতাকর্মীদের সঙ্গে দূরত্ব, নির্বাচনী এলাকায় কম আসা, জ্যেষ্ঠ নেতাদের অবমূল্যায়ন এবং রাজনীতির নামে ঠিকাদারি বাণিজ্য প্রাধান্য পাওয়ায় কুমিল্লার চারটি আসনে আওয়ামী লীগের নৌকা প্রতীকের চার প্রার্থী হেরেছেন। আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের তৃণমূল নেতাকর্মীর সঙ্গে কথা বলে এ তথ্য জানা গেছে।
কুমিল্লা-২ (হোমনা ও মেঘনা) আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী ছিলেন সেলিমা আহমাদ। তিনি ২০১৮ সালে প্রথমবার নৌকা প্রতীক নিয়ে নির্বাচিত হওয়ার পর হোমনা উপজেলা আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের সঙ্গে তাঁর দূরত্ব সৃষ্টি হয়। ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) নির্বাচনে দলের ত্যাগী নেতাদের বাদ দিয়ে পছন্দের ব্যক্তিকে চেয়ারম্যান পদে মনোনয়ন দেওয়ায় নেতাকর্মীরা ক্ষুব্ধ ছিলেন।হোমনা উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান রেহানা বেগমের সঙ্গেও তাঁর দূরত্ব ছিল। এছাড়া হোমনা ও মেঘনা উপজেলা আওয়ামী লীগ ছিল তাঁর বিপক্ষে। সেলিমা এবার হোমনা উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মো. আবদুল মজিদের কাছে ১ হাজার ৯৬১ ভোটের ব্যবধানে পরাজিত হন। আবদুল মজিদ স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে ট্রাক প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করেন।
হোমনা উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এ কে এম ছিদ্দিকুর রহমান বলেন, গত পাঁচ বছর এমপি মেরীর অত্যাচারে হোমনাবাসী অতিষ্ঠ হয়ে উঠে। দলের নেতাকর্মীদের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করায় তিনি প্রবীন রাজনীতিক অধ্যাপক আব্দুল মজিদের কাছে পরাজিত হয়েছেন। দলের কর্মীদের নামে মামলাও করেন। যে কারণে হোমনাবাসী তাঁর বিপক্ষে রায় দিয়েছে।
কুমিল্লা-৩ (মুরাদনগর) আসনের আওয়ামী লীগের প্রার্থী ছিলেন ইউসুফ আবদুল্লাহ হারুন। তিনি ২০১৪ সালে স্বতন্ত্র ও ২০১৮ সালে আওয়ামী লীগ থেকে সংসদ সদস্য হন। এর আগে ১৯৯৬, ২০০১ ও ২০০৮ সালে নৌকা প্রতীক নিয়ে তিনবার পরাজিত হন। গত নির্বাচনে জয় পাওয়ার পর এলাকায় তিনি কম আসতেন। নেতাকর্মীরা তাঁর দেখা পেতেন না। ঢাকায় গেলেও সাক্ষাৎ পেতেন না। গত ইউপি নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে প্রার্থী মনোনয়ন ও সমর্থনে ভুল সিদ্ধান্ত নেওয়ায় তাঁর ওপর ক্ষুব্ধ ছিলেন দলের একাংশের নেতাকর্মীরা।এছাড়া তলে তলে এ আসনের বিএনপিদলীয় সাবেক সংসদ সদস্য কাজী শাহ মোফাজ্জল হোসাইন কায়কোবাদের অনুসারীরা ইউসুফ আব্দুল্লাহ হারুনের বিপক্ষে পরোক্ষ ভূমিকায় ছিলেন। ইউসুফ আব্দুল্লাহ হারুন তাঁর দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী কুমিল্লা উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক স্বতন্ত্র প্রার্থী ঈগল প্রতীকের জাহাঙ্গীর আলমের কাছে এবারের নির্বাচনে ১১ হাজার ৯৫৭ ভোটে পরাজিত হন।
মুরাদনগর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ তানভীর আহমেদ বলেন, প্রকৃত আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা ওনার কাছে যেতে পারতেন না।
কুমিল্লা-৪ (দেবিদ্বার) আসনে আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থী ছিলেন রাজী মোহাম্মদ ফখরুল। ২০১৪ সালে স্বতন্ত্র ও ২০১৮ সালে নৌকা প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করেন। নির্বাচনে জয়ী হওয়ার পর আওয়ামী লীগের জ্যেষ্ঠ নেতাদের সঙ্গে তাঁর দূরত্ব সৃষ্টি হয় । তিনি তরুণ ও উঠতি বয়সী ছেলেদের প্রাধান্য দেওয়ায় এসব তরুণদের বেশির ভাগই ঠিকাদারি, জবরদস্তি ও নানা ধরনের অপরাধমূলক কার্যক্রমে জড়িয়ে পড়েন। ইউপি নির্বাচনে দেবিদ্বারে নৌকার বেশির ভাগ প্রার্থী পরাজিত হন।
এ ছাড়া গত বছর দেবিদ্বার পৌরসভা নির্বাচনে মনোনয়নপ্রত্যাশী দলের জ্যেষ্ঠ নেতাদের বাদ দিয়ে তরুণ একজনকে মেয়র পদে মনোনয়ন দেন। এতে ক্ষুব্ধ হন জ্যেষ্ঠ নেতারা। তার ওপর রাজীর বাবা সাবেক উপমন্ত্রী এ এফ এম ফখরুল ইসলাম মুন্সী মারা যাওয়ায় তিনি বেকায়দায় পড়েন। গত উপজেলা নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে তিনি তাঁর চাচা কুমিল্লা উত্তর জেলা বিএনপির সদস্যসচিব এ এফ এম তারেক মুন্সীর পক্ষে অবস্থান নেন। রাজীর অনুসারীরা প্রকাশ্যে ধানের শীষ প্রতীকে ভোট দেন।
এ ছাড়া ইতিপূর্বে জাতীয় সংসদ ভবনে এবারের নির্বাচনের তার প্রতিদ্বন্দী আবুল কালাম আজাদকে প্রকাশ্যে ঘুষি মারেন। আওয়ামী লীগের তৃণমূলের নেতাকর্মীরা এ নিয়ে এমপি রাজীর ওপর ক্ষুব্ধ ছিলেন। ৭ জানুয়ারি নির্বাচনের দিন রাজীকে দেবিদ্বার উপজেলার সূর্যপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ধাক্কা দেন প্রতিপক্ষরা, এতে তিনি আঘাত পান। রাজী নিজেই গণমাধ্যমকর্মীদের বিষয়টি জানান। নির্বাচনে রাজী তাঁর রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী ঈগল প্রতীকের আবুল কালাম আজাদের কাছে ১৫ হাজার ৫৫০ ভোটে পরাজিত হন।
দেবিদ্বার পৌর আওয়ামী লীগের সভাপতি আবুল কাশেম বলেন, আমাদের অবমূল্যায়ন করার ফল পেয়েছেন রাজী মোহাম্মদ ফখরুল।
কুমিল্লা-৫ (বুড়িচং-ব্রাহ্মণপাড়া) আসনের আওয়ামী লীগের প্রার্থী ছিলেন এডভোকেট আবুল হাসেম খান। ২০২১ সালের ২৫ জুন উপনির্বাচনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন তিনি। এবারও তিনি নৌকা প্রতীক নিয়ে প্রার্থী হন। মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার পর অসুস্থতার কারণে তিনি প্রচারণা ও গণসংযোগে বেশি সময় দিতে পারেননি। এ আসনে আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্র প্রার্থী ছিলেন তিনজন। দলের নেতাকর্মীরা চার ভাগে ভাগ হয়ে চার প্রার্থীর পক্ষে কাজ করেছেন। নির্বাচনে নৌকা প্রতীকের আবুল হাসেম খান তৃতীয় হন। তিনি কুমিল্লা দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের ত্রান ও সমাজ কল্যাণ সম্পাদক স্বতন্ত্র প্রার্থী কেটলি প্রতীকের এম এ জাহেরের কাছে ৪৩ হাজার ৪৯৫ ভোটের ব্যবধানে পরাজিত হন। এম এ জাহের ব্রাহ্মণপাড়া উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান পদ থেকে পদত্যাগ করে এবারের দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে অংশগ্রহণ করে জয়লাভ করেন। নির্বাচনে তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন কুমিল্লা দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ফুলকপি প্রতীকের স্বতন্ত্র প্রার্থী সাজ্জাদ হোসেন।
বুড়িচং উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আখলাক হায়দার বলেন, একেকটা লোকের কাজের কৌশল দেখে ভোটাররা সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, কাকে ভোট দেবেন। গত আড়াই বছর হাসেম খান সংসদ সদস্য ছিলেন। তাঁর কার্যক্রম দেখে ভোটাররা এবারে রায় দিয়েছেন।
Last Updated on January 9, 2024 6:29 pm by প্রতি সময়