স্বাস্থ্যই সম্পদ। আর এ সম্পদের অন্যতম অংশ হলো হার্ট।২৯ সেপ্টেম্বর বিশ্ব হার্ট দিবস। এবারে বিশ্বজুড়ে করোনার প্রাণঘাতি ছোবলের মধ্যেই পালিত হবে বিশ্ব হার্ট দিবস।এ দিবসটিকে সামনে রেখে অনলাইন নিউজপোর্টাল “প্রতিসময়’ এর স্বাস্থ্য পাতায় সোমবার ও বুধবারের আয়োজনে আজ স্বাস্থ্য বিষয়ক একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিবেদন লিখেছেন হার্টকেয়ার ফাউন্ডেশন কুমিল্লার প্রতিষ্ঠাতা ও সভাপতি অধ্যাপক ডা. তৃপ্তীশ চন্দ্র ঘোষ।
আমরা একটা অপ্রত্যাশিত সময় পার করছি।সারাবিশ্বের মতোবাংলাদেশেও চলছে করোনার ভয়াল আগ্রাসন। এপর্যন্ত শতাধিক চিকিৎসকসহ প্রায় পাঁচ সহস্রাধিক মানুষ এই কোভিড-১৯ -এ আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু বরণ করেছে। বিশ্বব্যপি এই মৃত্যু সংখ্যা ১০লাখ ছুঁইছুঁই করছে।সবচেয়ে লক্ষনীয় বিষয়টি হলো এই করোনায় আক্রান্ত হয়ে যারা মারা যাচ্ছে তাদের অধিকাংশেরই মৃত্যুর কারণ হচ্ছে মায়োকার্ডাইটিস থেকে শুরু করে অ্যাকিউট করোনারি সিনড্রোম এবং হার্ট ফেইলিউরের মতো হৃদরোগ।আবার যারা আগে থেকেই হৃদরোগে ভুগছেন তারা কোভিড আক্রান্ত হলে মৃত্যুর ঝুঁকি বেশি। এছাড়াও আগে থেকে ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, দীর্ঘমেয়াদী ফুসফসের রোগ. কিডনি ফেইলিউর এবং ক্যান্সারের মতো মারাত্মক সহযোগী রোগ থাকলেও করোনায় আক্রান্তদের মৃত্যুহার বেশী।
সুতরাং এই করোনা মহামারীর বিরুদ্ধে আমাদের লড়তে হবে হৃদয় দিয়ে। আমরা জানিনা এই মহামারী ভবিষ্যতে কতদিন স্থায়ী হবে। কিন্তু আমরা এটা জানি যে, আমাদের হার্টের যত্ন নেয়া অতীতের যেকোন সময়ের চেয়ে এখন অনেক বেশি জরুরী।
কারণ হৃদরোগ বর্তমান বিশ্বের এক নম্বর ঘাতকব্যাধি। প্রতিবছর ১ কোটি ৭৯ লক্ষ মানুষের মৃত্যু হয় এই রোগে এবং আশংকা করা হচ্ছে ২০৩০ সাল নাগাদ এই সংখ্যা বেড়ে দাঁড়াবে ২ কোটি ৩০ লাখে।
এই হৃদরোগের অনেকগুলো কারণ আছে। ধূমপান, ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ এবং স্থুলতা থেকে শুরুকরেবায়ু দূষণ এবং কার্ডিয়াক অ্যামাইলয়ডোসিসের মতো বিরল রোগও আছে।
আর এই করোনাকালে হৃদরোগীরা দুইদিক থেকেই হুমকির সম্মূখীন। তারা যে শুধু মারাত্মকভাবে ভাইরাসের ঝুঁকির মধ্যে তাই নয়, তারা তাদের হার্টের চিকিৎসা নেয়ার ক্ষেত্রেও ভয়ের মধ্যে আছে।
তাই এই ভয়াবহ করোনাকালে আমাদের প্রত্যেকের হার্টকে আরও বেশী শক্তিশালী করতে হবে। হার্টকে রোগমুক্ত রাখতে হবে। কারণ একটি রোগমুক্ত, শক্তিশালী হার্ট থাকলেই এই ভয়াবহ করোনা মহামারীর বিরুদ্ধে আমরা হৃদয় দিয়ে লড়াই করতে পারবো
আমরা জানি হার্টকে আরও বেশী শক্তিশালী করতে হলে হৃদরোগের রিস্ক ফ্যাক্টর বা ঝুঁকিগুলোকে চিহ্নিত করে সেগুলো দুর করতে হবে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই হৃদরোগ প্রতিরোধ করা সম্ভব যদি ধূমপান ও তামাক জাতীয় দ্রব্যের ব্যবহার, অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস এবং অপর্যাপ্ত শারীরিকশ্রম এই তিনটি রিস্ক ফ্যাক্টরকে আমরা দক্ষতার সাথে মোকাবেলা করে এগুলোকে জয় করতে পারি।
জীবনধারা পরিবর্তন করে হৃদবান্ধব জীবনচর্চার মাধ্যমে অর্থাৎ বেশি বেশী শারীরিক পরিশ্রম বা ব্যায়াম, স্বাস্থ্যসম্মত খাদ্যাভ্যাস এবং ধূমপান বা তামাকজাতীয় দ্রব্যের ব্যবহার কমিয়ে আনার মাধ্যমে আমরা আমাদের হৃদস্বাস্থ্যের উন্নতি ঘটাতেপারি। আবার স্বাস্থ্য বিষয়ক পরিমাপগুলোর উন্নতি ঘটিয়ে, যেমন – বি.এম.আই, উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, রক্তে উচ্চমাত্রায় কোলেস্টেরলসহ অন্যান্য হৃদরোগের ঝুঁকিগুলোকে কমানোর মাধ্যমে মানুষের সামগ্রিক স্বাস্থ্যের উন্নতি সম্ভব।
জীবনধারায় কি কি পরিবর্তন করা প্রয়োজন ?
১. স্বাস্থ্যসম্মত খাবার খাওয়া নিশ্চিত করুন – বেশী করে তাজা ফল ও শাক-সবজি খাবেন। অতিরিক্ত চর্বিযুক্ত খাবার বিশেষ করে সম্পৃক্ত চর্বি এড়িয়ে চলবেন। প্রক্রিয়াজাত খাবার খাওয়ার ব্যাপারে সচেতন হবেন কারণ এগুলো অতিমাত্রায় লবন দিয়ে তৈরী করা হয়ে থাকে।
২. কায়িক পরিশ্রম করুন এবং হার্টকে সুস্থ রাখুন – প্রতিদিন শুধুমাত্র ৩০ মিনিটের কায়িক শ্রম আপনাকে হার্ট অ্যাটাক এবং স্ট্রোক প্রতিরোধে সাহায্য করতে পারে।
৩. ধুমপান এবং তামাককে না বলুন – ধুমপান ও তামাকজাতীয় দ্রব্য বর্জনের মাধ্যমে আপনার করোনারি হৃদরোগের ঝুঁকি অর্ধেকে কমে আসবে এবং এক বছরের মধ্যে তা স্বাভাবিক অবস্থায় চলে আসবে।
৪. স্বাস্থ্যসম্মত ওজন বজায় রাখুন – শারীরিক ওজন স্বভাবিকের চেয়ে বেশী হলে বিএমআই বেড়ে যাবে এবং উচ্চ রক্তচাপ ও হৃদরোগের ঝুঁকিও বেড়ে যাবে। ওজন কমানোর পাশাপাশি লবন কম খেলে রক্তচাপ কমে আসবে। উচ্চ রক্তচাপ হলো স্ট্রোক -এর এক নম্বর কারণ। আর সকল হার্ট অ্যাটাক ও স্ট্রোকের প্রায় অর্ধেকের জন্যই দায়ী লো এই উচ্চ রক্তচাপ।
৫. আপনার সংখ্যা গুলো জানুন – একজন চিকিৎসকের নিকট গিয়ে আপনার রক্তচাপ, কোলেস্টেরল এবং গ্লুকোজ এর মাত্রা, কোমর ও নিতম্বের মাপের অনুপাত এবং বি.এম.আই পরিমাপ করে জেনে নিন। একবার আপনার ঝুঁকি সম্পর্কে জানতে পারলে আপনার হৃদস্বাস্থ্য উন্নয়নের জন্য বিশেষ কর্ম পরিকল্পনা গ্রহন করতে পারবেন।
৬. অ্যালকোহল গ্রহণ সীমিত রাখুন- অতিরিক্ত অ্যালকোহল গ্রহণের ফলে আপনার শারীরিক ওজন এবং রক্তচাপ বেড়ে যেতেপারে। কাজেই অ্যালকোহল গ্রহণের মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।
৭. ধোঁয়ামুক্ত পরিবেশ নিশ্চিত করুন – ধূমপান নিষিদ্ধ করার দাবি জানিয়ে আপনার কর্মস্থলকে ১০০% ধোয়ামুক্ত রাখুন। ধূমপান বর্জন কর্মসূচীকে সমর্থন করুন এবং ধূমপান বর্জনকারীদের আপনি নিজে, প্রতিষ্ঠান ও রাষ্ট্রীয়ভাবে সহযোগিতা দিতে উৎসাহিত করুন ।
৮. কর্মস্থলে ব্যায়াম চালু করুন – আপনার কর্মস্থলে যাওয়ার বাহন হিসাবে সাইকেল, লিফ্টের পরিবর্তে সিঁড়ি ব্যবহার এবং লাঞ্চ বিরতিতে একটু হাঁটার অভ্যাস করুন। সারাদিনে কাজের ফাঁকে নির্দিষ্ট সময় অন্তর পাঁচ মিনিটের বিরতি নিনএবং স্ট্রেচিং বা হালকা ব্যায়াম করে নিন।
৯. স্বাস্থ্যসম্মত খাবার নির্বাচন করুন – স্কুলগুলোতে বা আপনার কর্মস্থলের ক্যান্টিনে স্বাস্থ্যসম্মত খাবার সরবরাহ করতে বলুন অথবা নিকটবর্তী এমন কোন ক্যাফে খোঁজ করুন যেখানে স্বাস্থ্যসম্মত খাবার পরিবেশন করা হয়।
১০. দুঃশ্চিন্তামুক্ত থাকতে চেষ্টা করুন- দুঃশ্চিন্তাগ্রস্থ থাকলে একজন মানুষের ধূমপান ও মদ্যপানের প্রতি আসক্তি বেড়ে যায় এবং ফাস্টফুড ও জাঙ্ক ফুডের মতো অস্বাস্থ্যকর খাবার খাওয়া বেশী হয় যা প্রকৃতপক্ষে হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়।
সুতরাং এখানেই আপনার হৃদয়কে কাজে লাগাতে হবে।
আপনার মেধাকে ঠিকভাবে ব্যবহার করতে হৃদয় কাজে লাগান –
*হৃদহিতকর জীবনযাপন করতে কী প্রয়োজন, তা বোঝার জন্য জ্ঞানচর্চ্চায় কাজ করুন।
*বর্তমান এবং ভবিষ্যত জীবনের জন্য আপনার আচরণ পরিবর্তন করুন।
*করোনা প্রতিরোধে ঘরের বাইরে মাস্ক ব্যবহার করুন। যতদিন ভ্যাকসিন পাওয়া যাচ্ছে না, ততদিন “মাস্কই ভ্যাকসিন”।
আপনার প্রভাব কীভাবে ব্যবহার করবেন তার জন্যে হৃদয় কাজে লাগান –
*একজন ব্যক্তি হিসেবে আপনি আপনার প্রিয়জন ও সমাজে উদাহরণ সৃষ্টি করুন।
*একজন চিকিৎসক হিসেবে আপনার রোগীর স্বাস্থের পরিবর্তন ঘটাতে সাহায্য করুন।
*একজন কোম্পানীর মালিক হিসেবে আপনার কর্মচারীদের হৃদ-স্বাস্থ্য উন্নয়নে বাজেট বরাদ্দ করুন।
*রাষ্ট্র হিসেবে জনবান্ধব স্বাস্থ-নীতি প্রনয়ণ করুন এবং সমাজের মানুষের হৃদ-স্বাস্থ্যর উন্নতি ঘটাতে চিনির উপর কর আরোপ করে, ধূমপান নিষিদ্ধ করে এবং বায়ু দূষণ কমিয়ে আনতে কাজ করুন।
আপনার মানুষের জন্য সমবেদনা ও মানবিকতা জাগ্রত করতে হৃদয় কাজে লাগান –
*ব্যক্তি চিন্তার উর্ধ্বে ওঠে সমাজের দুর্বল এবং অরক্ষিত মানুষের সাহায্যে এগিয়ে আসুন।
*বয়স্ক এবং যারা আগে থেকেই হৃদরোগে ভুগছেন তারা কোভিড-১৯ সংক্রমনের ঝুঁকিতে আছেন তাদের প্রতি যত্নশীল হোন।
#দেশ-বিদেশের গুরুত্বপূর্ণ খবর জানতে protisomoy ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে এবং protisomoy news ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করে অ্যাকটিভ থাকুন।
Last Updated on September 30, 2020 8:36 am by প্রতি সময়