আজ ১৭ রমজান, ঐতিহাসিক বদর দিবস। ইসলামের ইতিহাসে প্রথম সম্মুখযুদ্ধ অনুষ্ঠিত হয় এদিনে। পৃথিবীতে ইসলাম থাকবে কিনা এ ফয়সালা হয় বদরের রণাঙ্গনে ঐতিহাসিক এক যুদ্ধের মাধ্যমে।
জাহিলিয়াতের তিমিরাচ্ছন্নতার অবসান ঘটিয়ে একত্ববাদের ঝান্ডা নিয়ে শান্তি ও সফলতার চাদরে আচ্ছন্ন নূরের আলোকে জগদ্বাসীর জন্য ইসলামের মতো মহান পবিত্র নিয়ামতের সুশীতল ঝর্ণাধারা প্রবহমান থাকার বিষয়টি সুনিশ্চিত হয়েছিল বদরের প্রাঙ্গণ থেকে। এজন্যই মানবসভ্যতার ইতিহাসে এ দিবসের গুরুত্ব ও তাৎপর্য অপরিসীম।
পবিত্র কোরআনে মহান আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে বদর দিবসকে ‘ইয়াওমুল ফুরকান’ তথা সত্য-মিথ্যার প্রভেদকারী দিবস হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে।
বস্তুত মহানবী সাল্লাল্লাহু তা’য়ালা আলাইহি ওয়া সাল্লাম যুদ্ধের পক্ষের মানুষ ছিলেন না। কিন্তু তৎকালীন অমুসলিম শক্তির নানামুখী ষড়যন্ত্র, নির্যাতন আর ইসলামকে অঙ্কুরেই বিনষ্ট করে দেওয়ার অপপ্রয়াস মোকাবিলায় রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু তা’য়ালা আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর হাতে যুদ্ধ ব্যতীত কোনো বিকল্প পথ ছিল না। তাওহীদ ও রিসালতের প্রতি আনুগত্যকারী মোহাজির ও আনসারদের সমন্বয়ে অসম সাহসী সাহাবায়ে কেরামের এক প্রত্যয়দীপ্ত বাহিনী রাহমাতুল্লিল আলামিনের নেতৃত্বে নজিরবিহীন বীরত্বের বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছে বদরের প্রান্তরে।
মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও সাহাবায়ে কেরামের সাথী হয়েছিল মহান আল্লাহপাক প্রদত্ত রহমত, মদদ ও সুসংবাদসংবলিত বার্তাবলির অমোঘ শক্তিমত্তা।
পবিত্র কোরআনের সূরা আল ইমরানে আল্লাহপাক ঘোষণা করেন- ‘সুনিশ্চিতভাবেই মহান আল্লাহ তোমাদের সাহায্য করেছেন বদরের যুদ্ধে, যেখানে তোমরা ছিলে ক্ষীণ-শক্তির দুর্বল এক পক্ষ।’ মূলত মুসলমানদের সংখ্যা, যুদ্ধাস্ত্র, সমর উপকরণ, শক্তিমত্তা ও সমরকৌশলের চাইতেও অধিক গুরুত্বপূর্ণ হলো মহান প্রভুর সাহায্য ও রহমতের বিষয়; যার ওপর প্রতিটি মুমিন সর্বাবস্থায় ভরসা করবে, নির্ভরতা পাবে।
আল্লাহপাক সে জন্যই বলেছেন, ‘ওয়া কানা হাক্কান আলাইনা নাসরুল মুমিনিন’। অর্থাৎ ‘মোমেনদের সহযোগিতা প্রদান করা আমি আল্লাহর জন্য অবশ্য কর্তব্য।’
৬২২ খ্রিষ্টাব্দে মহানবী (সা.) মদিনায় হিজরত করেন। হিজরতের এক বছর ৬ মাস ২৭ দিনের মাথায় অনুষ্ঠিত হয় বদরের যুদ্ধ। দিনটি ছিল দ্বিতীয় হিজরীর ১৭ রমজান শুক্রবার।
পরিসংখ্যানগত বিশ্লেষণে দেখা যায়, মুসলিম বাহিনীর চাইতে অমুসলিম বাহিনীর সৈন্য সংখ্যা ছিল প্রায় তিনগুণ। অমুসলিমদের অন্যান্য রসদ ও উপকরণ ছিল আরও বেশি। অমুসলিম সৈন্য সংখ্যা ছিল এক হাজারেরও অধিক। সঙ্গে ছিল ১০০ ঘোড়া, শতাধিক উট, ছয় শতাধিক লৌহবর্মসহ অন্যান্য যুদ্ধাস্ত্র। পক্ষান্তরে মুসলিম বাহিনীর সৈন্য সংখ্যা ছিল মাত্র ৩১৩। সঙ্গে যুক্ত ছিল ৭০টি উট ও মাত্র দুটি ঘোড়া। কিন্তু মুসলমানদের ছিল মানবতার সর্বশ্রেষ্ঠ নবী ও রাসূল হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর নেতৃত্ব এবং মহান আল্লাহর সাহায্য।
এ অসম যুদ্ধে কল্পনাতীত পরাজয় বরণ করে মহাসত্য অস্বীকারকারী প্রতিপক্ষ কাফিররা এবং অবিশ্বাস্য বিজয় লাভ করেন একত্ববাদের পতাকাবাহী আল্লাহপাকের অনুগত মজলুম বান্দারা।
ইসলাম, মহানবী (সা.) ও মহান আল্লাহপাকের জন্য জীবন উৎসর্গকারী কিছু মকবুল মানুষের বিশ্বাস, কর্তব্যনিষ্ঠা ও প্রতিশ্রুতির বিস্ময়কর সমাবেশ ঘটেছিল বদরের যুদ্ধে। সম্মিলিত কাফির বাহিনী করুণ পরিণতি বরণ করে। এর ফলে শুধু মক্কা-মদিনাতেই নয়; বরং সমগ্র আরব উপদ্বীপে ইসলাম এক অভিনব শক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ ঘটে এবং মুসলমানদের মর্যাদাও উজ্জ্বলতর হয়, যা থেকে পরবর্তী সময়ে তারা অধিকতর উদ্দীপনা ও অনুপ্রেরণামূলক অফুরান শক্তি লাভ করেন।
মহান আল্লাহ ভবিষ্যতের জন্য এ যুদ্ধের পরিপ্রেক্ষিতে সূরা আল ইমরানে সুসংবাদ দেন, ‘বরং তোমরা যদি সবর এখতিয়ার করো, মহান আল্লাহকে ভয় করার নীতি অবলম্বন করে চলো, তবে বিপক্ষ শক্তি তোমাদের ওপর দ্রুত হামলা করলেও আল্লাহপাক তোমাদের ৫ হাজার ফেরেশতার এক সুবিন্যস্ত বাহিনী দ্বারা সহযোগিতা করবেন।’
মহান আল্লাহ প্রদত্ত ফেরেশতা বাহিনীর এ সহযোগিতার কথা সূরা আনফালেও এসেছে, ‘যদি তুমি দেখতে ফেরেশতারা অবিশ্বাসীদের মুখমণ্ডল ও পৃষ্ঠদেশে আঘাত করে তাদের প্রাণ কেড়ে নিচ্ছে এবং বলছে যে, তোমরা এবার দহন যন্ত্রণা ভোগ করো।’
ইসলাম বদরের সিঁড়ি বেয়ে এভাবেই মহান আল্লাহর রহমত ও মদদে অত্যন্ত দ্রুত বেগে সম্মুখপানে এগিয়ে চলেছিল এবং পরিণত হয়েছিল জগতের সবচেয়ে দ্রুত বর্ধনশীল এক জীবন-বিধানরূপে।
আল্লাহপাকের বাণী- ‘নাসুরম্ মিনাল্লাহে ওয়া ফাতহুন কারিব’। অর্থাৎ আল্লাহর সাহায্য ও তোমাদের বিজয় অত্যাসন্ন, অতি নিকটে। ইতিহাস সাক্ষী, স্বল্পকালের ব্যবধানেই মহান রবের এ ঘোষণার পরিপূর্ণ সফল বাস্তবায়ন জগদ্বাসী প্রত্যক্ষ করেছে।
মহান আল্লাহ তায়ালা বর্তমান সারা বিশ্বে ঝঞ্জাট বিধ্বস্ত ও নির্যাতিত মুসলিম মজলুম ভাই বোনদের বদরি মদদ এবং ঈমানী শক্তি দান করুক। আমিন।
লেখক : চেয়ারম্যান -গাউছিয়া ইসলামিক মিশন, কুমিল্লা।
Last Updated on March 28, 2024 5:04 am by প্রতি সময়