কুমিল্লা শহরের অনতিদূরে অবস্থিত কমলপুর গ্রাম। এই গ্রাম থেকেই কুমিল্লার বাটিক কাপড়ের সুনাম এখন দেশ ছাপিয়ে বিদেশেও।
প্রায় ৫০ বছর আগে ওই গ্রামে মোম ও রঙের আঁচড় আর বøকের ছোঁয়ায় বাটিক কাপড়ের উত্থান ঘটে। ১৯৭৫ সালে লাল মিয়া ও মোহন মিয়া নামের দুই ভাইয়ের হাত ধরে কুমিল্লার কমলপুরে বাটিকের যাত্রা শুরু হয়ে এই পণ্যটি এখন ঐতিহ্যের জায়গায় স্থান করে নিয়েছে।
সময়ের পরিক্রমায় কমলপুর ও আশপাশের আরও কয়েকটি গ্রামে এখন প্রায় ২৫টি কারখানায় তৈরি হচ্ছে বাটিকের নান্দনিক ডিজাইনের শাড়ি, থ্রি-পিস, শার্ট, লুঙ্গি ও বেডশিট। অসংখ্য শ্রমিকের কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে বাটিকের রঙে রঙিন কমলপুর ও আশপাশের কয়েকটি গ্রাম। স্থানীয় জনগোষ্ঠীর চাহিদা মিটিয়ে ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেটসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় সরবরাহের পাশাপাশি বিদেশেও রপ্তানী হচ্ছে কুমিল্লার বাটিক। বিদেশের মাটিতেও এই পণ্যটি গুণগত মানের সুনাম কুড়াচ্ছে।
কুমিল্লার ঐতিহ্যবাহি খাদি কাপড়ের পরই জনপ্রিয়তার জায়গাটি ধরে রেখেছে বাটিক। কুমিল্লা নগরীর মনোহরপুর, কান্দিরপাড়, রামঘাট এলাকায় প্রায় দুই শতাধিক খাদিপণ্যের দোকান রয়েছে। এসব দোকানে কুমিল্লার বাটিকের সবধরণের পণ্যই পাওয়া যায়। খাদি কাপড়ের পণ্য কিনতে গিয়ে বাটিকের পণ্য কিনবেই ক্রেতারা। কারণ আরামদায়ক ও রুচিশীল রঙের বিভিন্ন ডিজাইনের বাটিকের কাপড় দিন দিন জনপ্রিয় হয়ে ওঠছে ক্রেতাদের কাছে। কুমিল্লা নগরীতে বর্তমানে বাটিক কাপড়ের সবচেয়ে বড় পাইকারি ও খুচরা বিক্রিস্থল হচ্ছে রাজগঞ্জ রাজবাড়ি গেইট সংলগ্ন হিলটন টাওয়ার। প্রতিদিন হাজারো ক্রেতার পদভারে মুখরিত থাকে হিলটনের বাটিক বাজার।
রঙে ও মানে অত্যন্ত টেকসই বাটিক এখন কেবল নারীই নয়, পুরুষের পছন্দের পোষাকের তালিকায়ও রয়েছে। নরসিংদি থেকে আনা কাপড়ে রঙ-তুলির আঁচড়, বøক ও এমব্রয়ডারির কাজে বাটিক কাপড়ে দেখা মিলছে আধুনিক সব নান্দনিক ডিজাইন। সম্প্রতি ফেসবুকে কুমিল্লা বাটিক কালেকশন পেইজে ভাইরাল হওয়া সিল্কের ওপর বাটিক প্রিন্টের শাড়ি হৈচৈ ফেলেছিল। বাটিকপ্রেমি নারীরা ওই শাড়ির জন্য হুমড়ি খেয়ে পড়েছিলেন হিলটন টাওয়ারে কুমিল্লা বাটিক কালেকশনের একাধিক শোরুমে।
কুমিল্লা বাটিক কালেকশনের পরিচালক শাহাদাত হোসেন রজিব জানান, ‘কেবল শাড়িই নয়, সালোয়ার-কামিজ-ওড়নায় বাটিকের নজরকাড়া নতুন নতুন নকশা ও বøক প্রিন্ট বাজারে আসছে প্রতি সপ্তাহেই। বেডশিটেও মিলছে নজরকাড়া ডিজাইন। আর বাটিকের আরামদায়ক লুঙ্গি, শার্ট ও পাঞ্জাবি-ফতুয়ার তো জুড়ি নেই। কুমিল্লার বাটিক দেশে যেমন ব্যাপকহারে বিপণন হচ্ছে তেমনি বিদেশেও রপ্তানী হচ্ছে। প্রবাসী বাংলাদেশিরা দেশে আসলে কুমিল্লার বাটিকের শাড়ি, থ্রি-পিস, লুঙ্গি যেমন নিজেদের জন্য কিনবেন, তেমনি প্রতিবেশি বিদেশিদের জন্যও উপহার হিসেবে বাটিক পণ্য কিনে নিবেন। মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরোপের কয়েকটি দেশে কুমিল্লার বাটিকের চাহিদা রয়েছে। বর্তমানে ক্রেতা চাহিদায় বেড়েছে বাটিক কাপড়ের উৎপাদনও। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পেলে কুমিল্লার বাটিক বিপণনে বাড়বে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি।’
কুমিল্লার বাটিক কাপড়ের ব্যবসার সঙ্গে জড়িতরা জানান, বর্তমানে শুধু কমলপুরেই রয়েছে বাটিকের সিল্ক ও সুতি শাড়ি, থ্রি-পিস, শার্ট, লুঙ্গি এবং বেডশিট তৈরির ১৫টির মতো কারখানা। সময়ের পরিক্রমায় ও ব্যাপক চাহিদায় কমলপুরের বাটিক এখন সীমানা ছাড়িয়ে পার্শ্ববর্তী আনন্দপুর, গলিয়ারা, বিবির বাজার গ্রামেও কারাখানা গড়ে ওঠেছে। অন্তত ২৫টি বাটিক কাপড়ের কারখানায় হাজারের অধিক শ্রমিকের কর্মসংস্থান হয়েছে। বাটিকের কারখানায় কাজ করে তারা এখন স্বাবলম্বী। এশিল্পের প্রসার ও বিপণনে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা এবং সহজশর্তে ঋণ প্রদানের সুযোগ সৃষ্টি করা গেলে অনেকেই বাটিক কাপড়ের কারখানা গড়ে তুলতে বা পোষাকের দোকান দিতে আগ্রহী হয়ে ওঠবে। বাটিক শ্রমিকদের একাজে দক্ষতা বাড়ানোর জন্য আরও উন্নত প্রশিক্ষণের প্রয়োজন বলে মনে করছেন ব্যবসায়িরা।
Last Updated on January 31, 2025 7:10 pm by প্রতি সময়