খাদির জন্য খ্যাত কুমিল্লার চান্দিনা ও দেবিদ্বার উপজেলায় যে চরকায় সুতা কাঁটা হতো সেই একই রকমের ৪৯টি চরকায় তৈরি হচ্ছে বিলুপ্ত মসলিনের মিহি সুতা। এ মিহি সুতো কেটে ঢাকায় পাঠানো হয়। সেখানেই বুনন হচ্ছে মসলিন শাড়ি। যা বাংলার ঐতিহ্য পুনরুদ্ধারে এক আলেকিত মাইলফলক। আর এরি মধ্যদিয়ে বাংলার ঐতিহ্যবাহী ও রাজসিক কাপড় মসলিনের ইতিহাসে যুক্ত হলো কুমিল্লার নাম।
জনশ্রুতি রয়েছে কাঁচের মতো স্বচ্ছ ওই মসলিন কাপড় একটি আংটির ভেতর দিয়ে অনায়াসে আনা-নেয়া করা যেতো এবং একটি দিয়াশলাই বাক্সেও রাখা যেতো। মোঘল স¤্রাট জাহাঙ্গীর তার স্ত্রী নূরজাহানকে মসলিন কাপড় দিয়ে বিয়ের প্রস্তাব পাঠিয়েছিলেন। এই মসলিন বাংলা থেকে হারিয়ে যায় ১৮৫৬ সালে। ওই সালে ইংল্যান্ডে মসলিন প্রদর্শনীর পর এদেশ থেকে বিলুপ্ত হয় ঐতিহ্যবাহী ও রাজসিক মসলিন কাপড়।
দেখতে দেখতে কেটে গেল প্রায় ১৬২ বছর। ১৮৫৬ সালের পর বাংলাদেশে আর মসলিন তৈরি হয়নি। পাকিস্তান শাসনামল থেকে শুরু করে বাংলাদেশের ৪০ বছরেও কেউ উদ্যোগ নেয়নি ঐতিহ্যের মসলিন তৈরিতে। ২০১৪ সালের ১২ অক্টোবর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পাট ও বস্ত্র মন্ত্রণালয় পরিদর্শনে এসে মসলিন পুনরুদ্ধারের নির্দেশ দেন। তারপর থেকে শুরু হয় গবেষণা। ২০১৮ সালে পাট ও বস্ত্র মন্ত্রণালয়ের অধীনে বাংলাদেশ তাঁত বোর্ডের তত্ত্বাবধানে শুরু হয় ‘বাংলাদেশ সোনালী ঐতিহ্য মসলিন তৈরির প্রযুক্তি ও মসলিন কাপড় পুনরুদ্ধার প্রকল্প’। এদিকে মসলিনের সূতা তৈরির জন্য রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল গবেষক গবেষণা করে ‘ফুটি কার্পাস’ তুলা চাষ করে সাফল্য এনে দেন। সেই তুলায় কুমিল্লার চান্দিনা উপজেলার সোনাপুর ও দেবিদ্বার উপজেলার রামপুর গ্রামে দুইটি কারখানায় অন্তত ৪৯টি চরকায় মসলিনের সুতা তৈরির কাজ করছেন নারীরা। যার মধ্যে চান্দিনার সোনাপুর কারখানায় রয়েছে ৩৭টি চরকা।
প্রকল্প সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মসলিনের পুনরুদ্ধার প্রকল্পের আওতায় কুমিল্লার চান্দিনা ও দেবিদ্বার অঞ্চলের ৪০ জন নারীকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। প্রশিক্ষণ শেষে ছয়জনকে বাছাই করা হয়। ওই ছয়জন এখন সুপারভাইজর হিসেবে কাজ করছেন। এ ছয়জনের অধীনে চরকায় সূতা কাটার কাজ করছেন দুই শতাধিক নারী। যারা সুপারভাইজরদের কাছ থেকে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে মসলিনের সুতা তৈরির পুরো কাজটাই করছন খুব যত্নসহকারে।
‘বাংলাদেশ সোনালী ঐতিহ্য মসলিন তৈরির প্রযুক্তি ও মসলিন কাপড় পুনরুদ্ধার প্রকল্প’ পরিচালক মো. আইয়ুব আলী জানান, হারিয়ে যাওয়া বাংলার ঐতিহ্যবাহী মসলিন পুনরুদ্ধারে কুমিল্লার চান্দিনার সোনাপুর ও দেবিদ্বারের রামপুরে ২০১৮ সালের জুলাই থেকে শুরু হওয়া চরকায় কাটা মসলিন সুতা দিনে দিনে সুক্ষম থেকে সুক্ষমতর হচ্ছে। এখানে বর্তমানে ২২৬জন নারী কাজ করছেন। তারা আগে মোটা সুতা কাটতো। আমরা তাদের ৩০০ থেকে ৭০০ মেট্রিকাউন্টের সূতা কাটার জন্য প্রশিক্ষণ দিয়েছি। হাতের চরকায় প্রথম দিকে ৮-১০ মেট্রিকাউন্ট সুতা তৈরি করলেও বর্তমানে ৫৫৬ মেট্রিকাউন্ট মিহি সুতা তৈরি করছে এখানকার নারী শ্রমিকরা। চান্দিনা ও দেবিদ্বারের চরকায় তৈরি সূতায় এপর্যন্ত পাঁচটি মসলিন শাড়ি, সাতটি মসলিন ওড়না ও ছয়টি নমুনা কাপড় তৈরি করা হয়েছে।
কুমিল্লায় খাদির চরকায় মসলিনের সূতা তৈরি হওয়া প্রসঙ্গে কুমিল্লা প্রেসক্লাবের সভাপতি মো. লুৎফুর রহমান বলেন, কুমিল্লা সবদিক থেকেই পথিকৃৎ। বিশ্বজুড়ে কুমিল্লার খাদির সুনাম আজও অমলিন। ঢাকাই মসলিনের দুইশ বছরের ইতিহাসের সঙ্গে কুমিল্লার নাম যুক্ত হয়ে আরেকটি বিরল সুনাম অর্জন করছে কুমিল্লা। মসলিন কাপড় পুনরুদ্ধার প্রকল্পটি নি:সন্দেহে প্রশংসনীয়। এ প্রকল্পের অধীনে মসলিন সূতা কাটার চরকা আরো বৃদ্ধি করাসহ চান্দিনায় শাড়ী তৈরির হ্যান্ডলুম স্থাপন করলে এ অঞ্চলের মানুষের কর্মসংস্থান বাড়বে এবং মসলিন কাপড় তৈরির জায়গাটি আরও সমৃদ্ধি পাবে।
সম্পাদকঃ শাহজাহান চৌধুরী
প্রধান সম্পাদক ও প্রকাশকঃ সাদিক হোসেন মামুন
কপি রাইটসঃ প্রতিসময় ডটকম