* স্মৃতিফলক ও নামকরণে দীপ্তিমান নজরুল" />
জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের জীবন ও সাহিত্যকর্মের এক তাৎপর্যপূর্ণ স্থান দখল করে আছে কুমিল্লা। তিনি তাঁর জীবনের গুরুত্বপূর্ণ সময়গুলো কাটিয়েছেন শিক্ষা-সাহিত্যের পাদপীঠ কুমিল্লায়। ১৯২১ সালের এপ্রিলে প্রথমবারের মতো কুমিল্লায় এসেছিলেন বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম। এরপর ১৯২৪ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত তিনি কুমিল্লায় মোট পাঁচবার এসেছেন। প্রায় তিন বছরে পাঁচবার কুমিল্লায় এসে অবস্থান করেছেন ১১ মাসেরও বেশি সময়। কুমিল্লায় বিভিন্ন সময় অবস্থানকালে সৃষ্টিশীল নানা গান, কবিতা লিখেছেন তিনি। কুমিল্লায় জড়িয়েছেন প্রেম ও বিয়ে। কবি নজরুলের রাজনৈতিক জীবনেও কুমিল্লার প্রভাব রয়েছে। তিনি ইংরেজ শাসনের বিরুদ্ধে ‘আনন্দময়ীর আগমনে’ কবিতা লিখে শহরের রাজগঞ্জে গ্রেফতার হয়েছিলেন।
কুমিল্লার মুরাদনগরের বাসিন্দা বই প্রকাশক আলী আকবর খানের সঙ্গে ১৯২১ সালের ৩ এপ্রিল প্রথম কুমিল্লা রেলস্টেশনে নামেন কবি নজরুল। কলকাতা থেকে চট্টগ্রাম মেইলে চড়ে কুমিল্লায় আসার পথে ট্রেনে বসেই তিনি রচনা করেন ‘নীলপরী’ কবিতাটি। ট্রেন থেকে রাতে কুমিল্লা স্টেশনে নেমে ওই রাতেই নজরুল কুমিল্লা শহরের কান্দিরপাড়ে তার সহপাঠী বন্ধু বীরেন্দ্র কুমার সেনের বাড়িতে ওঠেন। সেন বাড়িতে দু’দিন বেড়ানোর পর ৬ এপ্রিল আলী আকবর খাঁ নজরুলকে নিয়ে মুরাদনগরের বাঙ্গরা ইউনিয়নের দৌলতপুরে নিজ গ্রামে আসেন। সেখানে আলী আকবর খানের পুকুরে সাঁতার কেটে, পলো দিয়ে মাছ ধরে, জ্যোৎস্নারাতে পুকুরপাড়ের আমগাছের নিচে বাঁশি বাজিয়ে সময় কাটিয়েছেন কবি। দৌলতপুরে বসে কবি অসংখ্য কাব্য রচনা করেছেন। সেখানে কবি নজরুলের সঙ্গে আলী আকবর খানের বড় বোন আসমাতুন নেসার মেয়ে সৈয়দা খাতুনের পরিচয় হয়। কবি নজরুল সৈয়দা খাতুনের নাম দেন নার্গিস আসার খানম। নার্গিসের সঙ্গে কবি নজরুলের গভীর প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে, যা পরিণয়ে গড়ায়। ১৮ জুন পর্যন্ত কবি দৌলতপুরে ছিলেন। এরপর ১৯ জুন থেকে ৮ জুলাই পর্যন্ত কুমিল্লা শহরে ছিলেন। দ্বিতীয়বার ১৯২১ সালের নভেম্বরে কবি নজরুল কুমিল্লায় আসেন। এরপর ডিসেম্বরে কলকাতায় চলে যান। তৃতীয়বার ১৯২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে আসেন। এরপর জুন মাসে ফিরে যান। টানা চার মাস কুমিল্লায় অবস্থানকালে কবি নজরুলের সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে প্রমিলার। চতুর্থবার ১৯২২ সালের অক্টোবরে কুমিল্লায় আসেন। ইংরেজ শাসনের বিরুদ্ধে ভূমিকা রাখায় ও কবিতা লিখায় ২৩ নভেম্বর কবি নজরুলকে কুমিল্লা শহরের রাজগঞ্জ এলাকা থেকে গ্রেফতার করে কোতয়ালী থানায় আটক রাখা হয়। এরপর তাঁকে কলকাতায় পাঠানো হয়। বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম পঞ্চমবার ১৯২৩ সালের ১৫ ডিসেম্বর কুমিল্লায় আসেন এবং অবস্থান করেন ১৯২৪ সালের জানুয়ারী পর্যন্ত। ১৯২৪ সালের ২৫ এপ্রিল কাজী নজরুল ইসলামের বিয়ে হয় কুমিল্লা মেয়ে আশালতা সেনগুপ্তর সঙ্গে। তাঁর ডাকনাম ছিল দুলী। তবে কবি ডাকতেন প্রমীলা বলে। ভারতের কলকাতার ৬ নম্বর হাজি লেনে ওই বিয়ে হয়।
কুমিল্লার সঙ্গে কবি নজরুলের সম্পর্কগুলো স্মৃতিফলক ও নামকরণে আজও চিরজাগরুক হয়ে আছে। কবি নজরুল কুমিল্লার মুরানগরসহ শহরের যেসব এলাকায় অবস্থান করেছেন, আড্ডা দিয়েছেন, গল্প করেছেন, সঙ্গীত-সাহিত্য চর্চা করেছেন সেসব স্থানে নামফলক, স্মৃতিফলক নির্মাণ করে চেতনায় কবি নজরুলকে ধারণ করে আছে কুমিল্লাবাসী। ১৯৮৩ সালে কুমিল্লার তৎকালিন জেলা প্রশাসক সৈয়দ আমিনুর রহমানের উদ্যোগে নজরুল স্মৃতিরক্ষা পরিষদের সার্বিক ব্যবস্থাপনায় কুমিল্লায় কবির স্মৃতিবিজড়িত স্থানে স্থাপন করা হয় স্মৃতিফলক। এরমধ্যে মুরাদনগরের দৌলতপুরে কবি নজরুল মঞ্চ, মুরাদনগরের কোম্পানীগঞ্জ-নবীনগর সড়কের পাশে নজরুল তোরণ, আলী আকবর খানের দ্বিতল বাড়ি আঙ্গিনায় ‘আম তলা’ (যেখানে বসে কবি বাঁশি বাজাতেন), কুমিল্লা শহরের ঝাউতলা মসজিদের কাছে, ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজের উচ্চমাধ্যমিক শাখার পূর্ব-দক্ষিণ কোণে (রানীর দিঘির পাড়ে), নজরুল এভিনিউ সড়কের উত্তর ও দক্ষিণ পাশে, ফরিদা বিদ্যায়তনের সামনে, দারোগা বাড়ি, মুরাদপুর জানু মিয়া চৌধুরীর বাড়ি, দারোগা বাড়ি, চর্থায় শচীন দেববর্মনের বাড়ি, কান্দিরপাড় বসন্ত স্মৃতি পাঠাগার ও কবিপত্নী প্রমীলার বাড়ি এবং রাজগঞ্জ থানা এলাকায় স্মৃতিফলক রয়েছে।
এর আগে কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজের ডিগ্রী শাখায় ১৯৬০ সালে প্রতিষ্ঠা করা হয় কবি নজরুল ছাত্রাবাস। ১৯৬২ সালে কুমিল্লা শহরের কান্দিরপাড় থেকে ধর্মপুর পর্যন্ত সড়কের নামকরণ করা হয় নজরুল এভিনিউ। ১৯৬৯-১৯৭০ সালে কুমিল্লা নজরুল পরিষদ প্রতিষ্ঠা হয়। ১৯৭২ সালে ধর্মসাগরের উত্তর পাড়ে নজরুল পরিষদের জন্য জায়গা চিহ্নিত করা হয়। এটি বর্তমানে নজরুল ইন্সটিটিউট।
পরবর্তীতে ১৯৯১ সালে জেলা শিল্পকলা একাডেমি প্রাঙ্গনে চেতনায় নজরুল স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হয়। ১৯৯২ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া এটি উদ্বোধন করেন। ২০০৮ সালে কুমিল্লা বিশ^বিদ্যালয়ে কাজী নজরুল ইসলামের নামে ছাত্র হল প্রতিষ্ঠা করা হয়। ২০১৩ সালের এপ্রিলে কুমিল্লার ধর্মসাগরের উত্তর পাড়ে তিনতলাবিশিষ্ট নজরুল ইনস্টিটিউট কেন্দ্র চালু হয়।
বিশিষ্ট নজরুল গবেষক ও লেখক অধ্যাপক শান্তিরঞ্জন ভৌমিক বলেন, বাংলাদেশের মধ্যে কুমিল্লায় কবি কাজী নজরুল ইসলামের সাহিত্যকর্ম বেশি। তিনি অজস্র গান ও কবিতা রচনা করেছেন এই কুমিল্লায় ১১ মাসেরও বেশি সময় অবস্থান করে। কুমিল্লায় কবি নজরুলের স্মৃতিফলকগুলো অক্ষত থাকে এজন্য সবাইকে আন্তরিক হতে হবে। কুমিল্লায় কবি নজরুলকে নিয়ে গবেষণার অনেক সুযোগ রয়েছে।
# সাদিক/প্রতিসময়/২৫মে/২৫
Last Updated on May 25, 2025 11:29 am by প্রতি সময়