মাটি খেকোদের জন্য শুষ্ক মৌসুমের পুরো সময়টা যেন সোনায় সোহাগা। আর এই সময়টিকে কাজে লাগিয়ে অবাধে ফসলি জমির উপরিভাগের মাটি কেটে বিক্রি করা হচ্ছে। কুমিল্লার বিভিন্ন এলাকার নিচু জায়গা ভরাট, ইটভাটায় ইট তৈরিসহ নানা কাজের জন্য অসাধু মাটি ব্যবসায়ীরা প্রলোভন দেখিয়ে, কখনো ভয়ভীতি দেখিয়ে জমির মালিক বা কৃষকের কাছ থেকে কিনে নিচ্ছেন তিন ফসলি জমির উপরিভাগের (টপসয়েল) মাটি। এতে করে এসব জমি উর্বরতা শক্তি হারিয়ে অনাবাদিতে পরিণত হচ্ছে।
কুমিল্লার সদরসহ বেশ কটি উপজেলায় প্রশাসনের নজরদারিতেও বন্ধ হচ্ছে না ফসলি জমির মাটি খেকোদের দৌরাত্ম্য। মাটি খেকো চক্রের বিস্তৃতি এতোটাই যে, প্রশাসনের অভিযানেও তা বন্ধ করা যাচ্ছে না। কুমিল্লার যেসব এলাকার জমি থেকে এক্সকাভেটর (ভেকু মেশিন) বা ড্রেজার দিয়ে মাটি কাটা হয়ে থাকে এসব জমিতে ধান, পাট, গম, ভুট্টা, আলু, সরিষা, মরিচ, বেগুনসহ বিভিন্ন জাতের কৃষিপণ্য উৎপাদন হয়ে থাকে। এসব আবাদি জমির উপরিভাগের মাটিই এক শ্রেণির মাটি ব্যবসায়ী কৃষকদের কাছ থেকে কম দামে কিনে বেশি দামে বিক্রি করে লাভবান হচ্ছেন। ফসল উৎপাদনের জন্য জমিতে শতকরা ৫ ভাগ জৈব উপাদান দরকার এবং তা সাধারণত মাটির ওপর থেকে আট ইঞ্চি গভীর পর্যন্ত থাকে। কৃষকরা জমির উর্বরতা শক্তির ক্ষতি হবে, এমন দিক চিন্তাভাবনা না করেই সামান্য কেউ লাভের আশায় কেউবা প্রভাবশালী মাটি খেকোদের ভয়ে জমির ভবিষ্যতের ফসল উৎপাদনের পথ বিক্রি করে দিচ্ছেন। জমির মালিক বা কৃষকের চোখের সামনেই মাটির উপরিভাগের চার/পাঁচ ফুট পর্যন্ত কেটে নিচ্ছে মাটি খেকোরা।
গত কয়েকদিন ধরে খোঁজখবর নিয়ে জানা গেছে, কুমিল্লা সদরের গোমতীর উত্তর ও দক্ষিণ পাড়ে চানপুর, পাচথুবী এলাকার হাজার হাজার হেক্টর ফসলি জমির মাটি দিনে-রাতে কাটা হচ্ছে। মুরাদনগরের গোমতী নদীর চর এলাকায় অন্তত এক হাজার হেক্টর ফসলি জমি প্রতিদিন ভেকু মেশিনের আঘাতে ক্ষতবিক্ষত হচ্ছে। মাটি খেকোরো স্থানীয় প্রশাসনের কিছু অসাধু লোক এবং এলাকার প্রভাবশালী যুবক ও কতিপয় সাংবাদিককে ম্যানেজ করে প্রতিদিন ভেকু মেশিন বা ড্রেজার বসিয়ে ড্রাম ট্রাক, ট্রাক্টর করে ফসলি জমির মাটি গভীর করে কেটে নিয়ে ইটভাটাসহ বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের কাছে বিক্রি করে ‘আঙুল ফুলে কলাগাছ’ হচ্ছেন। এছাড়াও চৌদ্দগ্রামের অর্ধশত স্পটে, লালমাই উপজেলার অন্তত ৩৫টি স্পটে, সদর দক্ষিণ, নাঙ্গলকোট, বরুড়া, চান্দিনা, দেবিদ্বার, বুড়িচং, ব্রাহ্মণপাড়াসহ বিভিন্ন উপজেলায় সহস্রাধিক স্পটে ফসলি জমির মাটি যাচ্ছে ইটভাটাসহ নিচু জমি ভরাটের কাজে।
সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, কোথাও জমিতে দুই থেকে তিন ফুট, কোথাও পাঁচ থেকে সাত ফুট গভীর করে মাটি কাটা হচ্ছে। মাটি কাটার কাজে ভেকু মেশিন ব্যবহার করতে দেখা গেছে। জমির পাশে দাঁড়ানো ট্রাক্টরে মাটি তুলছেন শ্রমিকেরা। মাটি ভর্তি ড্রাম ট্রাক, ট্রাক্টরগুলো অন্যের জমি মাড়িয়ে চলাচল করছে।
কুমিল্লা জেলা প্রশাসক মো. আমিরুল কায়সার সাংবাদিকদের জানান, কৃষিজমির টপসয়েল বা উপরিভাগের মাটি কেটে শ্রেণি পরিবর্তন করা সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ। এ কাজের সঙ্গে জড়িত জমি ও ইটভাটার মালিক উভয়ের জন্যই সমান শাস্তির বিধান রাখা হয়েছে। কৃষিজমি থেকে যারাই মাটি কাটার সঙ্গে জড়িত থাকুক না কেন, অভিযোগ পেলেই তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়ে থাকে। মাটি কাটা বন্ধে দিনে এবং রাতেও অভিযান পরিচালনা অব্যাহত রয়েছে।
মুরাদনগর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আবদুর রহমান জানান, এ উপজেলার যেসব স্পটে ফসলি জমি ও নদীর পাড়ের মাটি কাটা হয় সেখানে অভিযান পরিচালনা করা হয়েছে। এরিমধ্যে মাটি কাটা চক্রের বিরুদ্ধে উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে মামলা করা হয়েছে। মাটি কাটার সঙ্গে উপজেলা প্রশাসনের লোকজনের জড়িত থাকার বিষয়টি তিনি অস্বীকার করেন।
চৌদ্দগ্রাম উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) জাকিয়া সরওয়ার লিমা জানান, ইতিমধ্যে কয়েকটি এলাকায় অভিযান পরিচালনা করে বেশ কয়েকটি ভেকু ও ড্রেজার মেশিনসহ মাটি কাটা সরঞ্জামাদি জব্দ করা হয়েছে। কয়েকজনকে অর্থদন্ড ও কারাদন্ডও দেওয়া হয়েছে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর কুমিল্লার উপ-পরিচালক আইউব মাহমুদ জানান, কৃষিজমির উপরিভাগের মাটি কাটলে জমি তার উর্বরতা হারায়। মাটির গভীরে মাটি খনন মেশিনের আঘাতে নষ্ট হয় প্রাকৃতিক লাঙ্গল কেঁচোসহ জমির উপকারী পোকামাকড়। এতে জমির স্থায়ী ক্ষতি হয়। এভাবে কৃষক বা জমির মালিকরা উপরিভাগের মাটি বিক্রি অব্যাহত রাখলে ফসল উৎপাদনও আশঙ্কাজনক হারে কমে যাবে। উপজেলা কৃষি কর্মকর্তারা মাঠ পর্যায়ে কৃষক ও জমির মালিকদের উপরিভাগের মাটি বিক্রি না করতে পরামর্শ দিয়ে থাকেন।
সম্পাদকঃ শাহজাহান চৌধুরী
প্রধান সম্পাদক ও প্রকাশকঃ সাদিক হোসেন মামুন
কপি রাইটসঃ প্রতিসময় ডটকম