একাত্তরের মার্চে স্বাধীনতাযুদ্ধের দামামা বেঁজে ওঠে।সেই যুদ্ধে কুমিল্লার অসসংখ্য মুক্তিযোদ্ধা জীবন বাজি রেখে অংশ নেয়।ভারত সীমান্ত ঘেঁষা কুমিল্লার কটকবাজার স্বাধীনতাযুদ্ধের এক অবিস্মরণীয় নাম।যেখান থেকে একাত্তরের ৯ মে পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে এ অঞ্চলে প্রথম যুদ্ধের সূচনা করে মুক্তিযোদ্ধারা।
কুমিল্লায় ২নম্বর সেক্টরের অধীনে সদরের বিবির বাজার সীমান্তে কটকবাজার বাঙ্কার থেকে পাকিস্তানী বাহিনীর বিরুদ্ধে এখানকার মুক্তিযোদ্ধারা একাত্তরের ৯ মে ভোরে সর্বপ্রথম এঅঞ্চলে সরাসরি যুদ্ধের সূত্রপাত ঘটায়।কুমিল্লা অঞ্চলে মুক্তিযুদ্ধের প্রথম লড়াইয়ে শহীদ হয় সাত মুক্তিযোদ্ধা। যাদের তিনজনের লাশ পাওয়া গেলেও বাকিদের খুঁজে পাওয়া যায়নি।স্বাধীনতাযুদ্ধের দীর্ঘ সময় অতিবাহিত হলেও কুমিল্লার কটকবাজারের এ ইতিহাস ঢাকা পড়েছিল ঝোপঝাড়ে।কুমিল্লা মুক্তিযোদ্ধা সংসদ জেলা কমান্ডের কমান্ডার সফিউল আহমেদ বাবুলের প্রচেষ্টায় ২০০৬ সালের দিকে২নং সেক্টরের কটকবাজারের নিশ্চিহ্ন সেই বাঙ্কারের পাশেই সমাহিত তিন শহীদ মুক্তিযোদ্ধার কবরের সীমানা প্রাচীর করে সেখানে শহীদ মুক্তিযোদ্ধা এবং ওই অঞ্চলে যুদ্ধকালীন সময়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় থাকা মুক্তিযোদ্ধাদের নাম ফলক স্থাপন করা হয়।২০০৬ সালে মুক্তিযোদ্ধা বিষয়ক মন্ত্রণালয় থেকে প্রকাশিত বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ সেক্টরভিত্তিক ইতিহাস বইয়ে কটকবাজার যুদ্ধের বিষয়টির সারসংক্ষেপ উল্লেখ রয়েছে।
‘কটকবাজার মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতিসৌধ’
অবশেষে মুক্তিযুদ্ধ এবং এ অঞ্চলের মুক্তিযোদ্ধাদের স্মৃতি অম্লান করে রাখতে ২নং সেক্টরের অন্যতম যুদ্ধক্ষেত্রটি ‘কটকবাজার মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতিসৌধ’ রূপে বর্ণাঢ্য আয়োজনের মধ্যদিয়ে বিজয়ের এদিনে উদ্বোধন হল। কুমিল্লা মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা হাজী আ.ক.ম বাহাউদ্দিন বাহার এমপি ‘কটকবাজার মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতিসৌধ’র উদ্বোধন করেন।এর আগে এবছরের ঐতিহাসিক ৭ মার্চ এ স্মৃতিসৌধের ভিস্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন কুমিল্লার জেলা প্রশাসক আবুল ফজল মীর।
কুমিল্লা জেলা প্রশাসন ও কুমিল্লা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সার্বিক পরিকল্পনা ও ব্যবস্থাপনায় ‘কটকবাজার মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতিসৌধ’ নির্মাণে সহযোগিতা করেছেন বীর মুক্তিযোদ্ধা হাজী আ.ক.ম বাহাউদ্দিন বাহার এমপি ও সংরক্ষিত মহিলা আসনের এমপি বীর মুক্তিযোদ্ধা আরমা দত্ত।
বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদ, কুমিল্লা জেলা কমান্ডের আয়োজনে বুধবার (১৬ ডিসেম্বর) দুপুরে ২নং সেক্টরের অন্যতম যুদ্ধক্ষেত্র ‘কটকবাজার মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতিসৌধ’ উদ্বোধন উপলক্ষে অনুষ্ঠিত আলোচনা সভায় প্রধান অতিথি ও উদ্বোধক ছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা হাজী আ.ক.ম বাহাউদ্দিন বাহার এমপি।বিশেষ অতিথি ছিলেন কুমিল্লা জেলা প্রশাসক আবুল ফজল মীর ও পুলিশ সপার সৈয়দ নুরুল ইসলাম। সভাপতিত্ব করেন বীর মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার সফিউল আহমেদ বাবুল।অনুষ্ঠান সঞ্চালনায় ছিলেন ডেপুটি কমান্ডার নন্দন চৌধরী।
উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে অতিথিবৃন্দ
‘কটকবাজার মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতিসৌধ’র উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে ২নং সেক্টরের যুদ্ধকালীন স্মৃতি ধরে তুলে বীর মুক্তিযোদ্ধা এমপি হাজী বাহার বলেন- মহান স্বাধীনতাযুদ্ধে এক অনন্য অবস্থানে ছিল কুমিল্লা। একাত্তুরের স্বাধীনতাযুদ্ধ এ অঞ্চলের মুক্তিযোদ্ধা ও সাহসী মানুষেরা বীরোচিত ভূমিকা রেখেছিল। স্বাধীনতাযুদ্ধে কুমিল্লার অনেক বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হয়েছেন। কটকবাজার বাংলাদেশ ও ভারতের সীমান্ত এলাকা হওয়ায় স্থানটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। তিনি শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের আত্মার শান্তি কামনা করেন এবং আগামী প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধের সকল স্মৃতি ঘিরে স্বাধীনতার চেতনাকে ধারণ করার আহ্বান জানান।
এমপি বাহার বলেন, একাত্তরের ৭মার্চ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর একটি ডাক সারা বাংলায় মুক্তিকামী মানুষদের যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার সাহস প্রেরণা দিয়েছে। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্ব ও দিক নির্দেশনার মধ্য দিয়ে আমরা বিজয়ের চূড়ান্ত জায়গায় পৌঁছতে পেরেছিলাম। যেই রেসকোর্স ময়দান থেকে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা সংগ্রামের ডাক দিয়ে ছিলেন, একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বর বিকেলে সেই ময়দানেই পাকিস্তানী বাহিনী আত্মসমর্পন করেছে। এটাই বিজয়ের বড় ইতিহাস।
এমপি বাহার আরো বলেন- আজকে নানা রকম যড়যন্ত্র হচ্ছে। এসবের বিরুদ্ধে আমাদের রুখে দাঁড়াতে হবে। প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে যেভাবে বাংলাদেশ এগিয়ে চলছে, এই অগ্রগতি, এই সমৃদ্ধি কোন ষড়যন্ত্রই থামাতে পারবে না। হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর সম্মান আমরা রাখবোই রাখবো।
প্রসঙ্গত, ১৯৭১ সালের ৯ মে ভোর পাঁচটা থেকে দুপুর সাড়ে ১২ টা পর্যন্ত আদর্শ সদর উপজেলার জগন্নাথপুর ইউনিয়নের কটকবাজারে ভয়াবহ যুদ্ধ হয়। ২ নম্বর সেক্টরের অধীনে ওই যুদ্ধ হয়। কটকবাজার বাংলাদেশ ও ভারতের সীমান্ত এলাকা হওয়ায় মুক্তিবাহিনী ও পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল। যে কারণে মুক্তিবাহিনীর ছোট ছোট কমান্ডোর দল গোমতী নদী অতিক্রম করে সেখানে অবস্থান নেয়। ২নম্বর সেক্টর কমান্ডার মেজর খালেদ মোশাররফ ও ক্যাপ্টেন রেজাউল আহমেদের নেতৃত্বে ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টের একটি কোম্পানী, ইপিআরের তিনটি কোম্পানী, মুজাহিদ ছাত্র ও আনসারের একটি কোম্পানী ওই যুদ্ধে অংশ নেয়। তখন পাক হানাদার বাহিনীর ৩১ পাঞ্জাব এবং ৩৯ বেলুচ রেজিমেন্ট এই এলাকায় যুদ্ধে নিয়োজিত ছিল।৯ মে সাড়ে সাত ঘণ্টাব্যাপী ওই যুদ্ধ হয়।মুক্তিযোদ্ধারা বাঙ্কারে থেকে যুদ্ধে অংশ নেয়। এতে পাক বাহিনীর অন্তত দেড়শো সৈন্য মারা যায়। মুক্তিবাহিনীর গোলাবারুদ শেষ হয়ে যাওয়ার পর ওই স্থান ত্যাগ করার সময়ই সাতজন মুক্তিবাহিনীর সদস্য শহীদ হোন। এর মধ্যে তিনজনকে কটকবাজার গোমতী নদীর পাড়ে কবর দেওয়া হয়। তাঁরা হলেন ঢাকা মেডিকেল কলেজের ছাত্র শহীদ ইমতিয়াজ উদ্দিন আহমেদ, শহীদ হাবিলদার জুম্মা মিয়া বীরবিক্রম ও শহীদ লেন্স নায়ক আবদুল কাদের মোল্লা বীরপ্রতীক। অন্য চারজনের লাশ খুঁজে পাওয়া যায়নি।
# দেশ-বিদেশের গুরুত্বপূর্ণ খবর জানতে প্রতিসময় (protisomoy) ফেসবুক পেইজে লাইক দিন। এছাড়া protisomoy ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন ও বেলবাটন ক্লিক করে নতুন নতুন ভিডিও নিউজ পেতে অ্যাকটিভ থাকুন।
সম্পাদকঃ শাহজাহান চৌধুরী
প্রধান সম্পাদক ও প্রকাশকঃ সাদিক হোসেন মামুন
কপি রাইটসঃ প্রতিসময় ডটকম