কুমিল্লার মুরাদনগর উপজেলায় কিছুতেই থামছেনা কৃষি জমি থেকে অবৈধ ভাবে ড্রেজার মেশিন দিয়ে মাটি উত্তোলন। এতে বিলীন হচ্ছে উপজেলার হাজার হাজার তিন ফসলি জমি। উপজেলার ২২টি ইউনিয়নে প্রায় দুই শতাধিক অবৈধ ড্রেজার দিয়ে প্রতিনিয়ত কৃষি জমি থেকে মাটি উত্তোলন করছে স্থানীয় কিছু চক্র।
অন্যদিকে অপর একটি চক্র ড্রেজার ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে মাসোয়ার নামে আদায় করছে বিপুল অর্থ। মাসোয়ারা দিলে সচল থাকে ড্রেজার মেশিন। না দিলে ভ্রাম্যমান আদালতের মাধ্যেমে ওইসব ড্রেজার মেশিন জব্দ করা হয়।
স্থানীয় প্রশাসন ভ্রাম্যমান আদালতের মাধ্যেমে অভিযান চালালেও রহস্যজনক কারনে ওই ড্রেজার ব্যবসায়ী চক্রগুলো বিরুদ্ধে কোন প্রকার মামলা না করায় চক্রটি দিন দিন বেপরোয়া হয়ে উঠছে। অপরদিকে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা অভিযানে বের হলে ঘটনাস্থলে পৌছাঁর আগেই খবর চলে যায় ড্রেজার ব্যবসায়ীদের কাছে। যার ফলে ঘটনাস্থলে গিয়ে তাদেরকে পাওয়া যায়না। তবে ব্যবসায়ীদের না পেলেও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা তার অভিযান শেষে অবৈধ ড্রেজার মেশিন জব্দ করে নিয়ে আসার কয়েক ঘন্টার মধ্যেই আবারো সেখানে বসানো হয় অবৈধ ড্রেজার মেশিন।
সোমবার সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, উপজেলার ৩১২টি গ্রামের মধ্যে প্রায় দু’শতাধিক গ্রামের কোন না কোন স্থানে অবৈধ ড্রেজার মেশিন চলে। মাইলের পর মাইল পাইপ সংযোগ দিয়ে ড্রেজিংয়ের মাটি দিয়ে কোথাও ফসলি জমি আবার কোথাওবা পুকুর ভরাট করা হচ্ছে। বর্তমানে অবৈধ ড্রেজিংয়ের কারণে ৫০/৬০ ফুট গভীর থেকে মাটি ও বালি উত্তোলনের ফলে আশ-পাশের তিন ফসলের জমিগুলো পরিনত হচ্ছে কুপে।
উপজেলার ছালিয়াকান্দি, বোরারচর, কৃষ্ণপুর, কামাল্লা গ্রামের মোবারক হোসেন, আলফু মিয়া, ইদন ব্যাপারীসহ বেশ কয়েকজন কৃষক বলেন, ড্রেজার বসিয়ে গভীর ভাবে মাটি কাটার কারনে আমাদের তিন ফসলী জমি ড্রেজিং গর্তে বিলীন হয়ে যাচ্চে। কেউ যদি ইচ্ছা করে জমি দিতে না চায়, তাহলে সেখান থেকে জোর পূর্বক মাটি কাটা শুরু করে শেষ পর্যন্ত ড্রেজার মালিকদের নিকট কমমূল্যে জমি ছেড়ে দিতে বাধ্য হয় সাধারণ কৃষক। ড্রেজার সিন্ডিকেটরা জমির মালিকদের বিভিন্নভাবে হুমকি-ধমকি দিয়ে জিম্মি করে রাখে।
ড্রেজার ব্যবসায়ী হারুন মুন্সী বলেন, সবাই মনে করে আমরা ড্রেজার চালাইয়া কতটাকা জানি কামাইতাছি। আসলে এক সময় ঠিকই কামাইতে পারতার। প্রতি প্রজেক্টে দেড় থেকে ২ লাখ টাকা লাভ হইতো। তখন কাউরে অতো টাকা দিতে হইতো না। এখন ড্রেজার মেশিন বসিয়ে পাইপ লাগানোর সাথে সাথে চলে আসে নায়েব সাব (ইউনিয়ন তহসিলদার) তারে দিতে হয় ১৫-২০ হাজার টাকা। মেশিন চালু করতে না করতে গলায় কার্ড ঝুলাইয়া হাতে লাঠির কতো একটা মাইক লইয়া হাজির হয়ে পরিচয় দেয় আমি সাংবাদিক, টাকা না দিলে শ্রমিকদের মারধর পর্যন্ত করে। তাদের কে প্রতি সপ্তাহে দিতে হয় ৫-১০ হাজার টাকা। আবার অনেকে প্রাইভেটকার করে এসে বলে আমি কি ছোট সাংবাদিক হে তোর কি মনে হয়? তাদের কে দিতে হয় বেশি টাকা। এর পর আসে স্থানীয় প্রভাবশালী ও রাজনৈতিক ব্যক্তি তাদের কাউকেও দিতে হয় টাকা। আবার মাঝে মধ্যে এসিল্যান্ড স্যার আইসা লইয়া যায় মেশিন। সেটিও নতুন করে কিনে বসাতে হয়। সব মিলিয়ে এখন তেমন একটা লাভ করতে পারি না।
উপজেলা কৃষি অফিস সূত্রে জানা যায়, উপজেলায় চাষাবাদযোগ্য জমির পরিমান ২৪ হাজার ২৯৩ হেক্টর। এর মধ্যে বেশীর ভাগই দুই থেকে তিন ফসলী জমি। অথচ সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, বিলের এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্ত পর্যন্ত অনাবাদী রয়েছে।
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মাইন উদ্দিন আহম্মেদ সোহাগ বলেন, আমি উদ্বিগ্ন ও আতংকিত। কেননা তিন ফসলি জমির টপসয়েল্ট (উর্ভর মাটির উপরের অংশ) ব্যাপক হারে কেটে নিচ্ছে। এ ধারা অব্যাহত থাকলে আগামী ৬ মাসের মধ্যে চাষাবাদের জন্য একখন্ড জমি থাকবে না। অথচ মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর থেকে কড়া ভাবে নিষেধাজ্ঞা আছে জমির মাটি কেটে নিয়ে অন্য কোন কাজে ব্যবহার করা যাবে না।
মুরাদনগর উপজেলার সহকারী কমিশনার (ভূমি) ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মোঃ নাজমূল হুদা বলেন, ভূমি অফিসের কোন কর্মকর্তা ড্রেজার ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে টাকা নিয়েছে এ বিষয়টি আমার জানা নেই। যদি কারও বিরুদ্ধে এমন কোন অভিযোগ পাই, তাহলে অবশ্যই ওই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। আমি আসার পরে এখন পর্যন্ত যেখান থেকেই ড্রেজারের অভিযোগ এসেছে সেখানেই অভিযান পরিচালনা করেছি। এটি বন্ধে আমাদের সবাইকে সচেতন হতে হবে তাহলেই হয়তো সম্ভব। আর অবৈধ ড্রেজার বন্ধে আমাদের অভিযান সবসময় অব্যাহত আছে।
এ বিষয়ে মুরাদনগর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) অভিষেক দাশ বলেন, এসব অবৈধ ড্রেজার নির্মূল করতে হলে প্রথমে আমাদের সকলকে আন্তরিক হতে হবে। প্রত্যেকটি জায়গা থেকে সকলকে সহযোগীতা করতে হবে। তাহলে এটি বন্ধ করা সম্ভব। তবে এখন পর্যন্ত যেখান থেকেই ড্রেজারের অভিযোগ এসেছে সেখানেই অভিযান পরিচালনা করা হয়েছে। আর অবৈধ ড্রেজার বন্ধে আমাদের অভিযান সবসময় অব্যাহত আছে।
সম্পাদকঃ শাহজাহান চৌধুরী
প্রধান সম্পাদক ও প্রকাশকঃ সাদিক হোসেন মামুন
কপি রাইটসঃ প্রতিসময় ডটকম