কুমিল্লার কৃতি সন্তান বাংলাদেশের প্রথম জাতীয় পতাকার মূল নকশাকার বীর মুক্তিযোদ্ধা শিব নারায়ণ দাস (৭৮) আর নেই।
আজ শুক্রবার (১৯ এপ্রিল) সকাল সাড়ে ৯টার দিকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বিএসএমএমইউ) চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মারা যান। সেখানে আইসিইউতে ভর্তি ছিলেন তিনি।
শিব নারায়ণ এর আগে রাজধানীর একটি বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন। শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে পরে তাকে বিএসএমএমইউতে ভর্তি করা হয়।
প্রধানমন্ত্রীর শোক
আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশের জাতীয় পতাকার নকশাকার বীর মুক্তিযোদ্ধা শিব নারায়ণ দাশের মৃত্যুতে গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করেছেন।এক বার্তায় তিনি প্রয়াত শিব নারায়ণ দাশের আত্মার শান্তি কামনা করেন এবং তার শোকসন্তপ্ত পরিবার-পরিজন, আত্মীয়স্বজন, গুণগ্রাহীদের প্রতি গভীর সমবেদনা জানান।
জাসদ নেতৃবৃন্দের শোক প্রকাশ
জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জাসদ) সভাপতি হাসানুল হক ইনু ও সাধারণ সম্পাদক শিরীন আখতার এক শোকবার্তায় শিব নারায়ণ দাসের মৃত্যুতে গভীর শোক ও শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা জানিয়েছেন।
এদিকে বীর মুক্তিযোদ্ধা শিব নারায়ন দাশের মৃত্যুতে জাসদ কুমিল্লা জেলা শাখার সাবেক সাধারন সম্পাদক এডভোকেট শহীদুল হক স্বপন এক শোকবার্তায় বলেছেন, শিব নারায়ন দাশ স্বাধীন বাঙালি জাতি রাস্ট্র বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার অন্যতম একজন সংগঠক ছিলেন। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ বৃহত্তর কুমিল্লা জেলা শাখার সাধারন সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করছেন। স্বাধীন বাংলার নিউক্লিয়াসের একজন সক্রিয় সদস্য হিসাবে বাংলাদেশের পতাকা নির্মাণের অন্যতম নকশাকার ও কুশীলব ছিলেন। মৃত্যুকালীন সময়ে মানবতার কল্যানে তার দেহ ও চক্ষুদান তাঁকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছে। মহান স্বাধীনতা সংগ্রামী, মুক্তিযোদ্ধা, সমাজতান্ত্রিক সমাজ বিনির্মানের লডাকু যোদ্ধা শিব নারায়ণ দাশ শত দুঃখ কষ্টকে জয় করেছেন হাসি মুখে, মাথা নত করেনি কখনও। লোভ লালসা, সুবিধাবাদের স্রোতে গা ভাসাননি। স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম বিরোধী রাজনৈতিক দল জাসদ প্রতিষ্ঠার অন্যতম সংগঠক, আজন্ম যোদ্ধা শিব নারায়ণ দাশের মৃত্যুতে জাতি তার একজন শ্রেষ্ঠ সন্তানকে হারালো।
কুমিল্লার রাজপথ থেকে উঠে আসা এই অশ্রান্ত পদাতিকের মৃত্যু আমাদেরকে ব্যথিত করে।
যতদিন পৃথিবীর বুকে লাল সবুজের পতাকার বাংলাদেশ থাকবে ততদিন বেঁচে থাকবেন শিব নারায়ণ দাশ। অন্তিম প্রয়ানে কমরেড শিবু দা কে লাল সালাম।
১৯৭১ সালের ২ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা ভবনের সামনে ওড়ানো হয় প্রথম বাংলাদেশের পতাকা। লাল এবং সবুজের ভেতরে হলুদ রঙে বাংলাদেশের মানচিত্র সম্বলিত ওই পতাকার নকশা যারা করেছিলেন, তাঁদের একজন ছিলেন সেই সময়ের ছাত্রলীগ নেতা শিব নারায়ণ দাশ।
শিব নারায়ণ দাসের জন্ম কুমিল্লায়। তার পিতা সতীশচন্দ্র দাশ। তিনি কুমিল্লায় আয়ুর্বেদ চিকিৎসা করতেন। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পাক হানাদাররা শিব নারায়ণ দাসের পিতা কে ধরে নিয়ে হত্যা করে। শিব নারায়ণ দাশের স্ত্রীর নাম গীতশ্রী চৌধুরী এবং এক সন্তান অর্ণব আদিত্য দাশ।
কুমিল্লায় আনা হবে মরদেহ
জাসদের দফতর সম্পাদক সাজ্জাদ হোসেন জানান, 'শনিবার সকাল ১০টায় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে শিব নারায়ণ দাসের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনের কর্মসূচি নেওয়া হয়েছে। তিনি বলেন, 'কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে ঢাকা জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে গার্ড অব অনার প্রদান এবং জাতির পক্ষ থেকে শ্রদ্ধা নিবেদনের পর শিব নারায়ণ দাসের মরদেহ কুমিল্লা নিয়ে যাওয়া হবে। বিকেল চারটায় সেখানে সর্বস্তরের জনগণের শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে তাঁর মরদেহ ঢাকায় ফিরিয়ে আনা হবে।'
শিব নারায়ণ দাস কুমিল্লার আরেক কৃতি সন্তান ভাষা সৈনিক ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের হাত ধরে রাজনীতিতে আসেন । ১৯৬২ সালের শিক্ষা আন্দোলন অংশগ্রহণ করে কারাবরণ করেন। তিনি ছাত্রলীগের সক্রিয় কর্মী ও নেতা ছিলেন।
জানা যায়, ১৯৭০ সালের ৭ জুন ঢাকার পল্টন ময়দানে অনুষ্ঠিত ছাত্রদের এক সামরিক কুচকাওয়াজে অংশগ্রহণ করার কথা ছিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের। এই জন্য ছাত্রদের নিয়ে একটি জয়বাংলা বাহিনী গঠন করা হয়। ছাত্রনেতারা এই বাহিনীর জন্য একটি পতাকা তৈরির সিদ্ধান্ত নেয়।
১৯৭০ সালের ৬ জুন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন ইকবাল হলের (বর্তমান সার্জেন্ট জহুরুল হক হল) ১০৮ নম্বর কক্ষে ছাত্রলীগ নেতা আ স ম আবদুর রব, শাহজাহান সিরাজ, কাজী আরেফ আহমদ, মার্শাল মনিরুল ইসলাম পতাকার পরিকল্পনা নিয়ে বৈঠকে বসেন। বৈঠকে আরও উপস্থিত ছিলেন ছাত্রলীগ নেতা স্বপন কুমার চৌধুরী, জগন্নাথ কলেজের ছাত্রলীগ নেতা নজরুল ইসলাম, কুমিল্লা জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ও কেন্দ্রীয় ছাত্রনেতা শিব নারায়ণ দাশ, প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগ সাধারণ সাধারণ সম্পাদক হাসানুল হক ইনু ও ছাত্রনেতা ইউসুফ সালাউদ্দিন।
সভায় কাজী আরেফের প্রাথমিক প্রস্তাবের ওপর ভিত্তি করে আলোচনা শেষে সবুজ জমিনের ওপর লাল সূর্যের মাঝে হলুদ রঙের বাংলার মানচিত্র খচিত পতাকা তৈরির সিদ্ধান্ত হয়। কামরুল আলম খান তখন ঢাকা নিউমার্কেটের এক বিহারি দরজির দোকান থেকে বড় এক টুকরো সবুজ কাপড়ের মাঝে লাল একটি বৃত্ত সেলাই করে আনেন।
এরপর প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের তিতুমীর হলের ৩১২ নম্বর কক্ষের এনামুল হকের কাছ থেকে অ্যাটলাস নিয়ে ট্রেসিং পেপারে আঁকা হলো পূর্ব পাকিস্তানের মানচিত্র। শিব নারায়ণ দাস পরিশেষে নিপুণ হাতে মানচিত্রটি এঁকে দেন লাল বৃত্তের মাঝে।.....
সম্পাদকঃ শাহজাহান চৌধুরী
প্রধান সম্পাদক ও প্রকাশকঃ সাদিক হোসেন মামুন
কপি রাইটসঃ প্রতিসময় ডটকম