পনের বছর বয়সে ১৯৮০ সালের দিকে কুমিল্লা শহরের নামকরা খাবার হোটেল শওকত-লিয়াকতে (ইমানিয়া হোটেল) ওয়েটারের কাজ নেন তফাজ্জল হোসেন। কুমিল্লা বরুড়া উপজেলার পিলগিরি গ্রামের তফাজ্জল টানা ৪৪ বছর একই মালিকের প্রতিষ্ঠানে ওয়েটারের কাজ করে রেস্তোরা অঙ্গণের পরিচিত মুখ হয়ে ওঠেন। সবার প্রিয় ওয়েটার তফাজ্জল এখন দুই বার বিসিএসে উত্তীর্ণ কন্যার গর্বিত পিতা। অনেকেই তফাজ্জলকে ডাবল বিসিএসধারী কন্যার বাবা বলেও ডাকেন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বাবা-মেয়ে প্রশংসায় ভাসছেন। দূর-দূরান্ত থেকে অনেকেই হোটেল ডায়নায় তফাজ্জলকে দেখতে আসছেন, তার সঙ্গে তুলছেন ছবিও।
কণ্ঠশিল্পী আসিফ আকবর তার ফেসবুক পেজে অনেকদিন আগেই তফাজ্জলকে নিয়ে লিখেছেন, ...‘মেয়ে নিজের পেশা নিয়ে আছে, বাবাও তার পুরনো পেশায় যথেষ্ট আনন্দিত। সৎ কাজে লজ্জা পায় কামচোর, জিতে যায় সময়। আমাদের তফাজ্জলই সেরা উদাহরণ, সাবাশ।’
হোটেল ওয়েটার তফাজ্জলের মেজো মেয়ে শাহনাজ আক্তার ৪০তম বিসিএসে (নন ক্যাডার) উত্তীর্ণ হয়ে ইন্সট্রাক্টর হিসেবে যোগ দেন নোয়াখালী বেগমগঞ্জ সরকারি টেকনিক্যাল স্কুল অ্যান্ড কলেজে। এরপর ৪৩তম বিসিএসেও উত্তীর্ণ হন তিনি। এবার যোগ দেবেন অর্থ মন্ত্রণালয়ের অধীনে সহকারী মহাহিসাব রক্ষক পদে।
তফাজ্জল বর্তমানে ওয়েটারের চাকরি করছেন কুমিল্লা শহরের হোটেল ডায়নায়। এটি ঐতিহ্যবাহী ইমানিয়া হোটেল মালিক পরিবারের প্রতিষ্ঠান। তফাজ্জল জানালেন, নিজে লেখাপড়া বলতে নাম স্বাক্ষর ছাড়া জানেন না। দাম্পত্য জীবনে চার সন্তানের পিতা। খুব আশা সন্তানদের উচ্চ শিক্ষিত করবেন। বড় ছেলে দিদার হোসেন লেখাপড়ায় অমনোযোগী হওয়ায় তাকে ঋণ করে বিদেশ পাঠিয়ে দেন। এরপর একমাত্র মেয়ে শাহনাজ আক্তার এবং ছেলে কবির হোসেন ও আক্তার হোসেনকে পড়ালেখায় উচ্চশিক্ষিত করার জন্য স্বপ্ন দেখেন।
তফাজ্জাল বলেন, তিনি রেস্তোঁরায় সামান্য বেতনে ওয়েটারের চাকরি করে সংসার ও সন্তানদের পড়ার ব্যয়ভার বহন করেছেন। এক্ষেত্রে হোটেল মালিক লিয়াকত আলী দুলালসহ অন্যরা তাকে আর্থিকভাবে অনেক সহযোগিতা করেছেন। তার স্ত্রী আয়েশা বেগম সন্তানদের লেখাপড়ার তদারকিতে সময় দিতেন। বাড়িতে সন্তানরা যেন কোনোভাবেই পড়াশোনায় অমনোযোগী না থাকে এজন্য তার স্ত্রীর ভূমিকা বেশি ছিল। ২০১২ সালে বরুড়ার আড্ডা কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করার পর একমাত্র মেয়ে শাহনাজকে বিয়ে দেন। বিয়ের পর সে পড়াশোনা অব্যাহত রাখে এবং কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজ থেকে গণিত বিষয়ে অনার্স-মাস্টার্স শেষ করে। তার এই মেধাবী মেয়ে দুই বার বিসিএস পরীক্ষায় অংশ নিয়ে দুইবারেই উত্তীর্ণ হয়েছে। ৩য় ছেলে কবির হোসেন মাস্টার্স ও ছোট ছেলে আক্তার হোসেন অনার্সে পড়ছে।
কুমিল্লা প্রেসক্লাবের সাবেক সভাপতি ও কলামিস্ট মাসুক আলতাফ চৌধুরী বিষয়টিকে মূল্যায়ন করে বলেন, ‘তফাজ্জল দীর্ঘদিন ধরেই ডায়নায় ওয়েটারের কাজ করে আসছেন। তার মেয়ে মেধাবী। বাবা নিম্ন আয়ের মানুষ হয়েও লেখা পড়া চালিয়ে গেছেন। পরিবারে লেখা পড়ার কদর ছিল। যার সুযোগে তার মেয়ে বিকশিত হয়েছে। নিজ যোগ্যতা প্রমাণ করতে পেরেছে। তাই বাবা হিসাবে তিনি সাধুবাদ পাওয়ার যোগ্য। প্রত্যেক বাবা-মায়ের উচিত তাদের অনুসরণ করা। সন্তান ছেলে বা মেয়ে হউক তাদের লেখা পড়া চালিয়ে যাওয়া।’
ওয়েটার তফাজ্জল হোসেনের মেয়ে শাহনাজ আক্তার বলেন,‘বাবার স্বপ্নপূরণ করতে পেরেছি বলে আমার খুব গর্ব হয়, বাবাকে নিয়ে। বাবা তার সামান্য আয়ে সংসার, আমাদের পড়াশোনার খরচ চালিয়েছেন। বাড়িতে মা অনেক খেয়াল রাখতেন। আমি নিজেও টিউশনি করে বাবার আয়ে যোগান দিতাম পড়ালেখার খরচে। আমার শিমুল মামাও পরামর্শ, সহযোগিতা করেছেন। বিয়ের পর আমার পড়শোনার ব্যাপারে স্বামী ও শ্বশুরবাড়ির লোকজনের অকৃত্রিম সাপোর্ট ছিল।’
সম্পাদকঃ শাহজাহান চৌধুরী
প্রধান সম্পাদক ও প্রকাশকঃ সাদিক হোসেন মামুন
কপি রাইটসঃ প্রতিসময় ডটকম