কুমিল্লার মুরাদনগরের আকুবপুর ইউনিয়নের কড়ইবাড়ি গ্রামের দেশজুড়ে আলোচিত ‘মব’ সৃষ্টি করে ট্রিপল মার্ডারের ঘটনার মূলহোতাদের একজন ইউপি মেম্বার বাচ্চু মিয়া আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দেওয়ার মত প্রকাশ করেও পরে আর দেননি।
রোববার (৬ জুলাই) বিকেলে চাঞ্চল্যকর তিন খুনের ঘটনায় ঢাকায় র্যাবের হাতে আটক ৬ আসামিকে কুমিল্লার আদালতে হাজির করে বাঙ্গরা বাজার থানা পুলিশ। এসময় মামলার এজহারনামীয় ৩ নাম্বার আসামি বাচ্চু মিয়া মেম্বার আদালতে স্বেচ্ছায় ১৬৪ ধারায় জবানবন্দী দিতে রাজি হলে তার বক্তব্য রেকর্ডের প্রক্রিয়া গ্রহণ করেন। কিন্তু আড়াই ঘন্টা পর বাচ্চু মেম্বার জানান তিনি জবানবন্দি দেবেন না। পরে তাকে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন আদালত। এর আগে বিকেলে বাকি পাঁচ আসামির জামিন নামঞ্জুর করে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন ৫ নং চীফ জুডিশিয়াল ম্যাজিষ্ট্র্যাট আদালতের বিচারক সিদ্দিক আজাদ।
এদিকে বাচ্চু মেম্বার গ্রেফতার হলেও অপর দুই হোতা ইউপি চেয়ারম্যান ও আওয়ামী লীগ নেতা শিমুল বিল্লাহ এবং স্থানীয় ব্যবসায়ী বাছির মিয়া এখনো অধরা।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, বাছিরের নেতৃত্বে হত্যাকাণ্ডের আগেরদিন বুধবার রাতে বৈঠক হয় এবং হত্যার পরিকল্পনা করা হয়। আর এই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে কড়ইবাড়ি গ্রামে রোকসানা আক্তার রুবির বাড়ির সামনে বৃহস্পতিবার (৪ জুলাই) সকাল সাড়ে ৬টায় ইউপি চেয়ারম্যান শিমুল বিল্লাহ ও ইউপি মেম্বার বাচ্চু মিয়া একত্রিত হয়ে শলা-পরামর্শ করেন। এর ৩০ মিনিট পরই খলিলুর রহমান জুয়েলের বাড়িতে হামলা শুরু করে এলাকার লোকজন। এ সময়ে উত্তেজিত জনতা পিটিয়ে ও কুপিয়ে ওই বাড়ির খলিলুর রহমান জুয়েলের স্ত্রী রোকসানা বেগম ওরফে রুবি (৫৩), তাঁর ছেলে রাসেল মিয়া (৩৫) ও মেয়ে তাসপিয়া আক্তার ওরফে জোনাকিকে (২৯) ঘটনাস্থলে হত্যা করে। এ ছাড়া গুরুতর আহত হয় রুবির আরেক মেয়ে রুমা আক্তার (২৭)। সে বর্তমানে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।
ঘটনার চারদিনেও আলোচিত এই হত্যাকান্ডের মূলহোতা শিমুল বিল্লাহ ও বাছির মিয়া গ্রেফতার হয়নি। যদিও এই ঘটনার মামলার আগে-পরে যৌথবাহিনী ও র্যাব পৃথক অভিযানে ৮ জনকে গ্রেফতার করেছে। র্যাবের গ্রেফতার তালিকার ৬ জনের মধ্যে রয়েছেন ঘটনার তিন মূলহোতার একজন ইউপি মেম্বার বাচ্চু মিয়া। সবশেষ গ্রেফতার ছয় জনকে রোববার বিকেলে আদালতে আনার পর তাদের কুমিল্লা কারাগার হাজতে পাঠানো হয়।
এদিকে বাঙ্গরা বাজার থানার ওসি মাহফুজুর রহমান ও র্যাব কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, মব সৃষ্টি করে সংঘটিত হত্যাকান্ডের ঘটনার মূল হোতা স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান শিমুল বিল্লাহ সহ মামলার পলাতক অন্যান্য আসামি ও ঘটনার সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের গ্রেফতারে অভিযান অব্যাহত রয়েছে।
এদিকে মব সৃষ্টি করে তিনজনকে হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় দায়ের করা মামলায় উঠে এসেছে নৃশংসতার তথ্য। মামলার বাদী নিহত রোকসানা আক্তার রুবির বড় মেয়ে রিক্তা আক্তার নিজেই ওই ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী ছিলেন।
তিনি জানান, ‘গত বৃহস্পতিবার সকাল সাতটার দিকে ইউপি চেয়ারম্যান শিমুল বিল্লাহ, ইউপি মেম্বার বাচ্চু মিয়া ও স্থানীয় বাছির মিয়ার নেতৃত্বে এলাকার লোকজনকে জড়ো করে আমাদের বাড়ি ঘেরাওয়ের পর বাড়িতে ইট পাটকেল ছুঁড়ে ভাঙচুর চালায়। তারা অকথ্য ভাষায় গালমন্দ করে আমার মা রোকসানা আক্তার রুবিকে নাম ধরে ডাকতে থাকেন। এ সময় মা ঘর থেকে বেরিয়ে এলে বাচ্চু মেম্বার মায়ের মাথায় কোপ দেন। একই সময়ে স্থানীয় চেয়ারম্যান শিমুল বিল্লাহ ও বাছির মিয়াও মাকে কোপাতে থাকেন। মাকে বাঁচাতে ঘর থেকে ছুটে আসেন আমার ছোট বোন জোনাকী। তখন জোনাকীর মাথায় কোপাতে থাকেন চেয়ারম্যান শিমুল বিল্লাহ, রফিকসহ কয়েকজন। জোনাকি ও মাকে কোপানোর খবর পেয়ে অনতিদূরেই শশুর বাড়ি থেকে মোটরসাইকেলে করে বাড়িতে আসেন আমার ভাই রাসেল। তখন শিমুল বিল্লাহসহ অন্যরা রাসেলকে কুপিয়ে ঘটনাস্থলে হত্যা করেন। এ সময় আমার ছোট বোন রুমা এগিয়ে এলে বাচ্চু মিয়া তাঁর হাতে থাকা রামদা দিয়ে মাথায় কোপ দেন। তখন রুমা পড়ে যান। এ সময় অন্যরাও তাঁর মাথায় কোপাতে থাকেন।তখন আমি দুই সন্তান নিয়ে পাশের দুটি বাসায় আশ্রয় নেওয়ার চেষ্টা করলেও সেখান থেকে বের করে দেওয়া হয়। পরে জরুরি সেবা ৯৯৯ নম্বরে কল দেওয়ার পর পুলিশ ঘটনাস্থলে আসে। তবে পুলিশ ঘটনাস্থলে আসার আগেই আমার মা, ভাই, বোনকে পিটিয়ে কুপিয়ে হত্যা করা হয়।’
মামলার বাদী রিক্তা আক্তার আরও জানান, ‘ইউপি চেয়ারম্যান শিমুল বিল্লাহ, বাচ্চু মেম্বার এবং স্থানীয় বাছিরের পরিকল্পনাতেই এই ঘটনা ঘটানো হয়েছে। বৃহস্পতিবার সকালে আমাদের বাড়ির সামনে এমন একটি পরিস্থিতি সৃষ্টি করার উদ্দেশ্যেই চেয়ারম্যান ও মেম্বার একত্রিত হয়েছিলেন, এবং পরিকল্পিতভাবে এই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছেন। আমাদের পরিবার এখনও নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। সকল আসামিদের দ্রুত গ্রেফতার ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করছি।
এদিকে এ ঘটনায় শুক্রবার রাতে মামলা দায়েরের আগেই যৌথবাহিনী কড়ইবাড়ি গ্রামের বাসিন্দা মো. সবির আহমেদ (৪৮) ও মো. নাজিমউদ্দীন বাবুল (৫৬) কে গ্রেফতার করে। শনিবার এই দুইজনকে আদালতের মাধ্যমে জেল হাজতে পাঠানো হয়।
অপরদিকে শনিবার সকালে রাজধানী ঢাকার বনশ্রী এলাকা থেকে র্যাব-১১ এর একটি টিম মুরাদনগরে ঘটে যাওয়া চাঞ্চল্যকর তিন খুনের (ট্রিপল মার্ডার) মামলায় ছয়জনকে গ্রেফতার করে। তারা হলেন- কড়ইবাড়ি গ্রামের ইউপি মেম্বার বাচ্চু মিয়া (৫৫), রবিউল আওয়াল (৫৫), আতিকুর রহমান (৪২), মো. বায়েজ মাস্টার (৪৩), হায়দরাবাদ গ্রামের দুলাল (৪৫) ও আকাশ (২৪)। গ্রেফতারদের মধ্যে তিনজন এজহারনামীয় ও বাকি তিনজনের ঘটনার সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা রয়েছে।
র্যাব জানিয়েছে, প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেফতার ছয় জন হত্যাকাণ্ডের দায় স্বীকার করেছে। মোবাইল চুরির ঘটনার জেরে পূর্বপরিকল্পিতভাবে তারা এই হত্যাকাণ্ড সংঘটিত করে।
Last Updated on July 7, 2025 11:49 am by প্রতি সময়