দ্রোহ, মানবতা ও সাম্যের কবি নজরুলের জীবন ও সাহিত্যের বর্ণিল অধ্যায় জুড়ে জড়িয়ে আছে পথিকৃৎ কুমিল্লা। এগার মাসে পাঁচবারের আগমন নজরুলের জীবনের মোড় ঘোরার প্রেক্ষাপট সৃষ্টি হয়েছে কুমিল্লাতেই। কবি নজরুল প্রথম কুমিল্লায় আসেন তার বিশিষ্ট বন্ধু মুরাদনগর উপজেলার দৌলতপুর গ্রামের আলী আকবর খাঁর সঙ্গে ১৯২১ সালের এপ্রিল মাসের ৫ তারিখ। কবি কোলকাতা থেকে কুমিল্লায় এসে প্রথমে আলী আকবর খানের বন্ধু ধীরেন্দ্র সেনের পিতা ইন্দ্রকুমার সেনের শহরের কান্দিরপাড়স্থ বাসায় উঠেন। এই বাড়িতে কবি নজরুল প্রায় ৩/৪দিন অবস্থান করেন।
এই কুমিল্লায় বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুলের আগমনের শতবর্ষ পূর্ণ হবে ৫ এপ্রিল সোমবার। কবি নজরুলের কুমিল্লায় আগমনের একশো বছর পূর্তির শুভক্ষন বর্ণাঢ্য আয়োজনে পালন করার প্রস্তুতি থাকলেও দেশব্যাপি করোনাভাইরাস প্রাদুর্ভাবের কারনে বাতিল করা হয়েছে সকল অনুষ্ঠান।
কবির কুমিল্লা আগমনের শতবর্ষ পূর্ণের দিন ৫ এপ্রিল থেকে শুরু দেশব্যাপি লকডাউন। তাই সকল আনুষ্ঠানিকতা বাতিল করা হয়েছে জানিয়েছেন কুমিল্লা শিল্পকলা একাডেমির কালচারাল অফিসার আয়াজ মাবুদ। তিনি জানান, স্বাস্থ্যবিধি মেনে ছোট্ট আকারে শিল্পকলা একাডেমি ও নজরুল ইন্সটিটিউট ও নজরুল পরিষদ শিল্পকলা একাডেমি প্রাঙ্গনের স্থাপিত চেতনায় নজরুলের ম্যুরালে শ্রদ্ধা জানানো হবে। করোনার পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে পরবর্তীতে ৫দিন ব্যাপি মূল অনুষ্ঠানের বিষয়ে সিদ্দান্ত নেওয়া হবে।
‘আমি চিরতরে দূরে চলে যাবো/তবু আমারে দেবো না ভুলিতে…। কাজী নজরুল ইসলামের এই চয়নটুকু চিরভাস্বর হয়ে আছে কুমিল্লাবাসীর হৃদয়ে।
কুমিল্লার মাটি ও মানুষের সঙ্গে নজরুলের রয়েছে অটুট বন্ধন। বাংলা সাহিত্যের ‘ধুমকেতু’ কবি কাজী নজরুল ইসলামের প্রেম-বিরহ, বিবাহ, সংগীত-সাহিত্য চর্চা ও ইংরেজ বিরোধী সংগ্রামের অসংখ্য স্মৃতি জড়িয়ে আছে শিক্ষা ও সাহিত্যের পাদপিঠ কুমিল্লার সঙ্গে।
কুমিল্লায় ৩/৪ দিন থাকার পর আলী আকবর খানের সাথে চলে যান মুরাদনগরের দৌলতপুরের বাড়িতে। সেখানে কবি প্রায় দু‘মাস অবস্থানকালে বহু গান-কবিতা রচনা করেন। এসময়টিতে নজরুলের সাথে পরিচয় ঘটে আলী আকবর খানের ভাগিনী নার্গিস আসার খানমের। তারপর প্রেম। একই বছরের ১৭জুন কবি নজরুলের বিয়ে সম্পন্ন হয় নার্গিস আক্তার খানমের সাথে। কিন্তু অজ্ঞাত কারণে কবি বিয়ের রাতেই দৌলতপুর ছেড়ে কুমিল্লা শহরে ইন্দ্র কুমার সেনের বাসায় চলে আসেন। এখানে তিনি ১৯দিন অবস্থান করে ৮ জুলাই কোলকাতা চলে যান।
কবি দ্বিতীয়বার কুমিল্লায় আসেন ১৯২১ সালের নভেম্বর মাসে। ছিলেন ১মাস। এসময়ে কবি বৃটিশ বিরোধী গান গেয়েছিলেন। তখন তাকে কুমিল্লা শহরের রাজগঞ্জ এলাকার রাস্তা থেকে পুলিশ গ্রেফতার করে।
কবি নজরুলের তৃতীয় বার আগমন ঘটেছিল ১৯২২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে। চার মাস অবস্থানের পর জুন মাসে তিনি ফিরে যান কোলকাতায়। এ চার মাস সময়ে প্রমীলার প্রেমের আকর্ষণ তাকে প্রভাবিত করে। যা শেষ পর্যন্ত পরিণয়ে গড়ায়।
নজরুল চতুর্থবার গ্রেফতার এড়াবার জন্য কুমিল্লায় আসেন। ধূমকেতু পত্রিকায় আনন্দময়ীর আগমন নামের কবিতা লেখার জন্য বৃটিশ সরকারের জারীকৃত গ্রেফতারী পরোয়ানা তখন তার মাথার উপর ঝুলছে। কিন্তু যে জন্য তার এ আসা তা তিনি এড়াতে পারেনি। ১৯২২ সালের ২৩ নভেম্বর বিকেলে তিনি শহরের ঝাউতলায় গ্রেফতার হন। এ সময়ে গ্রেফতারকৃত কবিকে কোলকাতা পাঠিয়ে দেয়া হয়।
কবি শেষবারের মতো কুমিল্লায় আসেন ১৯২৩ সালের ১৬ ডিসেম্বর জেল থেকে ছাড়া পাবার পর পরই। কবি নজরুলের কুমিল্লায় অবস্থানের ১১ মাস ছিল বৈচিত্র্যময়।
এ সময়ে তিনি অজস্র কবিতা ও গান রচনা করেছেন। এগুলোর মধ্যে উলেখযোগ্য কবিতা ও গান হলো অবহেলা, অনাদৃতা, বিদায় বেলায়, বেদনা, হারামণি, হারমানা হার, অভিমান, বিজয় গান, পথিক প্রিয়া, পরশ পূজা, পাগল পথিক, মনের মানুষ, বিধুরা, মরণ বরণ, বন্দীর বন্দনা ইত্যাদি।
কুমিল্লার ক’জন কৃতি সন্তান কবির কুমিল্লায় অবস্থানকালে সঙ্গী ছিলেন। তাঁরা হলেন, শচীন দেব বর্মন, মৌলভী পাড়ার আলম চৌধুরী, মোতাহের হোসেন চৌধুরী, দারোগা বাড়ির মোহাম্মদ হোসেন খসরু, কলেজ ছাত্র সুলতান মাহমুদ মজুমদার প্রমুখ।
Last Updated on April 4, 2021 10:06 pm by প্রতি সময়