বায়ুদূষণে মানুষের হৃৎপিণ্ডের ক্ষতি হচ্ছে বাড়ছে উচ্চ রক্তচাপের মতো রোগের হারও। ২৯ সেপ্টেম্বর বিশ্ব হার্ট দিবসকে সামনে রেখে অনলাইন নিউজ পোর্টাল ‘প্রতিসময়’ এর পাঠকদের জন্য স্বাস্থ্য বিষয়ক গুরুত্বপূর্ণ প্রতিবেদন লিখেছেন বিশিষ্ট হৃদরোগ ও মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ও হার্ট কেয়ার ফাউন্ডেশন কুমিল্লা’র প্রতিষ্ঠাতা ও সভাপতি অধ্যাপক ডা. তৃপ্তীশ চন্দ্র ঘোষ।
আমাদের প্রাকৃতিক সম্পদের অন্যতম উপাদান হলো বাতাস বা বায়ু। বিশুদ্ধ বাতাস মানুষের মৌলিক অধিকার। তবুও, বায়ু দূষণ বিশ্বব্যাপী মানুষের জন্য একটি মারাত্বক হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে – এটি স্বাস্থ্যের জন্য সবচেয়ে বড় পরিবেশগত হুমকি এবং হার্ট অ্যাটাক বা স্ট্রোকের মতো অসংক্রামক রোগের (এনসিডি) একটি প্রধান কারণ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, বহিরাঙ্গন এবং গৃহস্থালী বায়ু দূষণের সম্মিলিত প্রভাবের কারণে প্রতি বছর ৭০ লক্ষ মানুষের অকাল মৃত্যু হয়। আর বছরে হৃদরোগে যত মানুষের মৃত্যু হয় তার শতকরা ২৫ ভাগের জন্য দায়ী হচ্ছে বায়ুদুষণ। দূষিত বায়ু শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে গ্রহনের কারণে আরও কয়েক মিলিয়ন মানুষ অসুস্থ হয়ে পড়ছে। এই মৃত্যুর অর্ধেকেরও বেশি উন্নয়নশীল দেশগুলিতে রেকর্ড করা হয়েছে। বিশ্বের অন্যান্য অনেক দেশের মতো বাংলাদেশেও এই বায়ুদুষণ আজ এক ভয়াবহ রূপ নিয়েছে।
বায়ু দূষণ কি?
বায়ু দূষণ হল কঠিন কণা, তরল ফোঁটা এবং সেইসাথে গ্যাসের একটি জটিল মিশ্রণ। সুক্ষ কঠিন কণা থেকে ভারী ধাতু, জটিল জৈব-আবর্জনা, জিবাষ্ম জ¦ালানি, তেল-কয়লা পুড়িয়ে কার্বন ডাই-অক্সাইড, ক্লোরো ফ্লোরোমিথেন, নাইট্রাস অক্সাইড, রাসায়নিক ধোঁয়া ইত্যাদি সবই হলো বায়ুদুষণের প্রধান কারণ। তাছাড়া বায়ুদুষণের মূলে আছে কলকারখানা, মোটরগাড়ি, ট্রেন, ঘরবাড়ি ও ব্যবসা-বানিজ্য প্রতিষ্ঠানের যন্ত্রপাতি ও আবর্জনা।
বায়ুদুষণের আরেকটি দিক হলো ভ’পৃষ্ঠে ঊর্ধ্ধাকাশে স্ট্রাটোস্ফিয়ারে ভাসমান কণার পরিমাণ বৃদ্ধি। এসব কণার মধ্যে ধুলিকণা থেকে শুরু করে ঘর, কলকারখানা থেকে নির্গত নানা প্রকার রাসায়নিক কণাও থাকে। বাংলাদেশে জীবাষ্ম জ্বালানি দহন ছাড়াও বায়ু দুষণের অন্যান্য উৎসের মধ্যে রয়েছে ইটের ভাটা, সার কারখানা, চিনি, কাগজ, পাট ও বস্ত্র কারখানা, সুতাকল, চামড়াশিল্প, রাসায়নিক ও ঔষধ শিল্প, সিমেন্ট উৎপাদন, গ্রিল ও দরজা জানালার ওয়ার্কশপ, ক্ষেত-খামারের ধুলাবালি ইত্যাদি উৎস থেকে প্রচুর পরিমাণে ধোঁয়া, বাষ্প, গ্যাস ও ধুলিকনা ইত্যাদি বাতাসে মেশার ফলে বায়ুদুষণের পাশাপাশি পরিবেশও দুষিত হয়।
বিভিন্ন উৎসের বায়ু দূষণের বিভিন্ন মিশ্রণ হতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, সমুদ্রের কাছাকাছি একটি শহরে সমুদ্রের লবণ, রাস্তার ধুলো এবং ডিজেল ইঞ্জিন থেকে ধোঁয়া সমন্বিত কণা পদার্থ থাকতে পারে। বিপরীতে, একটি বনের কাছাকাছি একটি গ্রামীণ এলাকায় মাটি, রান্নার চুলার ধোঁয়া এবং বনের আগুনের সমন্বয়ে কণা পদার্থ থাকতে পারে। সকল বায়ু দূষণকারী কণাগুলোর পরিমাপ হলো পার্টিকুলেট ম্যাটার অর্থাৎ pm ২.৫ থেকে pm ১০ (একটি সুক্ষ্র কণা যার এরোডাইনামিক ডায়ামিটার ২.৫ মাইক্রোমিটারের সমান বা কম থেকে শুরু করে ১০ মাইক্রোমিটার পর্যন্ত হতে পারে), যার মধ্যে রয়েছে ওজোন (O3), নাইট্রোজেন ডাই অক্সাইড NO2), কার্বন মনোক্সাইড (CO) এবং সালফার ডাই অক্সাইড (SO২)।
মানুষের স্বাস্থ্যের উপর বায়ু দূষণের প্রভাব কি?
সূক্ষ কণা পদার্থ pm২.৫) ফুসফুসের মাধ্যমে প্রবেশ করতে পারে এবং পববর্তিতে রক্ত প্রবাহের মাধ্যমে শরীরের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে সমস্ত প্রধান অঙ্গকে প্রভাবিত করে।
pm ২.৫ এর এক্সপোজার আমাদের কার্ডিওভাসকুলার এবং শ্বাসযন্ত্রের উভয় রোগের কারণ হতে পারে, যেমন হার্ট অ্যাটাক ও স্ট্রোক, ফুসফুসের ক্যান্সার এবং ক্রনিক অবস্ট্রাকটিভ পালমোনারি ডিজিজ (COPD)।
নতুন একটি গবেষণায় দেখা গেছে, প্রসবপূর্ব অবস্থায় মায়ের উচ্চ মাত্রার বায়ু দূষণের এক্সপোজারের ফলে শিশুর তিন বছর বয়সে বিকাশগত বিলম্ব দেখা দেয় পরবর্তিতে শিশুর মনোযোগের ঘাটতি বা অ্যাটেনশন ডেফিসিট হাইপারঅ্যাকটিভিটি ডিসঅর্ডার (ADHD), উদ্বেগ এবং বিষন্নতার লক্ষণ সহ নানাধরনের মনস্তাত্বিক এবং আচরণগত সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে।
করণীয়
বায়ুদূষণে জনগনের এক্সপোজার হ্রাস করে উল্লেখযোগ্য স্বাস্থ্য সুবিধাগুলি অর্জন করা যেতে পারে। কলকারখানা, পরিবহন ব্যবস্থা, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, কৃষি এবং নগর পরিকল্পনায় নীতিগত পদক্ষেপের মাধ্যমে বায়ুদূষণ মোকাবেলা করে স্বাস্থ্য, জলবায়ু প্রশমন এবং টেকসই অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য অতিরিক্ত অন্যান্য সুবিধার দ্বার উন্মোচন করতে পারে।
১. প্রচুর বনায়ণ করতে হবে। গাছ কাটা নিষিদ্ধ করতে হবে এবং প্রচুর গাছ লাগাতে হবে।
২. বিকল্প জ্বালানি হিসেবে সৌর ও পানি বিদ্যুতের মতো উৎস ব্যবহার করতে হবে।
৩. শিল্পকারখানা, গৃহস্থালি ইত্যাদির বর্জ্য পদার্থ নির্দিষ্ট জায়গায় ফেলা এবং পরবর্তিতে পরিশোধনের ব্যবস্থা করা।
৪. কৃষিতে রাসায়নিক সারের ব্যবহার কমিয়ে জৈব সারের ব্যবহার বৃদ্ধি করতে হবে।
৫. কীটনাশকের ব্যবহার কমিয়ে আনতে হবে।
৬. সর্বোপরি বায়ুদুষণ তথা পরিবেশ দুষণ রোধে রাজনৈতিক ঐক্যমত অত্যন্ত জরুরী।
Last Updated on September 26, 2022 7:06 pm by প্রতি সময়