১৮৩৭ সালে স্যার হেনরি জর্জ ল্যাসিষ্টারের হাত ধরে মাত্র ৩৭জন ছাত্র নিয়ে জ্ঞানের প্রদ্বীপ শিখা মিটমিট করে জ্বলে উঠেছিল জিলা স্কুলে। কালের পরিক্রমায় তা শিখাচিরন্তনে রূপ নিয়ে আলোর ব্যাপ্তি ছড়িয়েছে সারা বাংলায়। ১৮৪ বছরের ইতিহাস, ঐতিহ্যের পথ ধরে আজকের সময়ে স্যার হেনরি জর্জের জিলা স্কুল মেধা ও প্রতিভা বিকাশে জ্ঞানের বাতিঘরে পরিণত হয়েছে। ঐতিহ্যবাহী এই স্কুলটিকে নিয়ে ‘অনলাইন নিউজপোর্টাল প্রতিসময়’ এর জন্য বিশেষ প্রতিবেদনটি লিখেছেন নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্বিবিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত কুমিল্লা জিলা স্কুলের সাবেক শিক্ষার্থী তানভীর মাহতাব আবীর…
১৮৩৭ সালের ২০ জুলাই কুমিল্লা শহরের প্রাণকেন্দ্র ধর্মসাগর পাড়ে একটি টিনশেড বাংলো ঘরে কুমিল্লা জিলা স্কুলের শিক্ষা কার্যক্রম শুরু হয়। ১৮৬২সালে ঘূর্ণিঝড়ে সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত হওয়ার আগ পর্যন্ত প্রায় ২৫ বছর এই বাংলোতেই স্কুলের যাবতীয় কার্যক্রম পরিচালিত হতো। সে বছরই ১৮৬২ সালে স্কুলে প্রথমবারের মত পাকা ইমারত তৈরি করা হয়। সেসময়কার ভবনগুলো কতটা টেকসই এবং দীর্ঘস্হায়ী তার প্রমাণ পাওয়া যায় এখানেও। সেই ইমারতটি প্রায় ১১০ বছর পেরিয়ে স্বাধীনতার পরেও টিকে ছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে এই বিল্ডিংটি সহ পুরো স্কুল ক্যাম্পাস সেনাবাহিনীর ক্যাম্প হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছিল।
১৮৫৪ সালে স্কুলের যাবতীয় কার্যক্রম ত্রিপুরার জনশিক্ষা দপ্তরের আওতায় আসে এবং ১৮৫৭ সালের জানুয়ারিতে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় (দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম বিশ্ববিদ্যালয় ছিল এটি) প্রতিষ্ঠিত হলে সে বছরই কুমিল্লা জিলা স্কুলকে বিশ্ববিদ্যালয়টির অধিভুক্ত করা হয়। সে বছরের মার্চে অনুষ্ঠেয় এন্ট্রান্স পরীক্ষা কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে অনুষ্ঠিত হয় এবং ফলাফলের উপর বৃত্তি চালু হয়। সেই বছর স্কুলটি ৪ হাজার ৯৩২ টাকা সরকারী অনুদান লাভ করে।
১৮৭১-১৮৮৫সালের সময়টায় স্কুলে ছাত্র সংখ্যা বাড়ার (৪০৪ জন) সাথে সাথে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে মুসলিম ছাত্রের সংখ্যাও। এ সময়কালে ৭০ জন মুসলিম ছাত্র অধ্যয়নরত ছিল স্কুলে। এর মধ্যে যারা গরীব বা আর্থিকভাবে অসচ্ছল ছিল তাদের জন্য মাসিক ৬৭ টাকা করে বৃত্তির ব্যবস্হাও ছিল। এই টাকা আসতো মহসিন ফান্ড থেকে।
তবে স্কুলের ছাত্রদের মেধার স্বাক্ষর রাখার প্রমাণ পাওয়া যায় আরও প্রায় ১৫ বছর পরে। ১৯০০সালে একজন ছাত্র কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে মেধা তালিকায় ২য় স্থান ও ১৯০১সালে অপর এক ছাত্র মেধা তালিকায় ৮ম স্থান অধিকার করে ১ম গ্রেডে ২০ টাকা বৃত্তি লাভ করেছিল।
বিংশ শতাব্দীতে ভারতীয় বাংলা ও হিন্দি গানের কিংবদন্তীতুল্য ও জনপ্রিয় সঙ্গীতজ্ঞ শচিন দেব বর্মণ ১৯২০ সালে মেট্রিক পাশ করেন শৈশবের স্কুল কুমিল্লা জিলা স্কুল থেকে। এক স্মৃতিচারণে তিনি বলে গিয়েছেন, ” স্কুলের সঙ্গেই লাগোয়া খেলার মাঠ ও তার পাশে বুড়ো বটগাছ। সেই গাছের নিচে আমাদের গানের নিয়মিত আসর জমত টিফিনের ছুটিতে। …গাইতাম খোলা মাঠে, পাশে ধর্মসাগর দিঘি- বড় বড় গাছের তলায়, রোদে, বৃষ্টিতে, ঝড়ে, বাদলে, শীতে, কী আনন্দই না পেয়েছি প্রকৃতির কোলে মাটির গান গেয়ে দিন কাটিয়ে।”
প্রায় পৌনে দুইশত বছরে এমন বহু শিক্ষার্থী কুমিল্লা জিলা স্কুলে নিজেদের শৈশবের শিক্ষা পেয়েছেন। সেই শিক্ষায় আলোকিত হয়ে স্কুলকেই নিয়ে গিয়েছেন গর্বের জায়গায়। স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকার প্রথম নকশাকার শিব নারায়ণ দাস ছিলেন স্কুলের ১৯৬৩ ব্যাচের শিক্ষার্থী। ব্র্যাকের প্রতিষ্ঠাতা স্যার ফজলে হাসান আবেদ এই স্কুলে ৭ম ও ৮ম শ্রেণীতে পড়াশোনা করেছেন।ছন্দকার, কবি, গীতিকার, গায়ক, সাহিত্যিক, খেলোয়াড়, বিচারক, রাজনীতিবিদ – এমন করেই এই স্কুলের ছাত্রদের সাফল্য ছড়িয়েছে সব ক্ষেত্রে।যুগে যুগে বহু আন্দোলন, যুদ্ধ দেখেছে এ দেশের মানুষ। তার প্রায় সবগুলোতেই এই স্কুলের ছাত্রদের অবদান অনস্বীকার্য। বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে গৌরবের সাথে লড়াই করেছেন স্কুলের ১৩৮ জন শিক্ষার্থী, হয়েছেন শহীদ, বরণ করেছেন পঙ্গুত্ব।
এভাবেই ইতিহাস ঐতিহ্যর কুমিল্লা জিলা স্কুল প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে জ্ঞানের এক অনন্য বাতিঘর হয়ে উঠেছে।
Last Updated on March 14, 2024 5:02 am by প্রতি সময়