ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের সময় ১৯২১ সালে মহাত্মা গান্ধীর ডাকে খাদি কাপড়ের জনপ্রিয়তা বেড়ে ওঠে। ‘স্বদেশী পণ্য গ্রহণ কর আর বিদেশি পণ্য বর্জন কর’ মহাত্মা গান্ধীর এ স্লোগানের ওপর ভিত্তি করেই তৎকালীন সময়ে খাদিশিল্পের উৎপত্তি হয়। সেই থেকে আজো স্বমহিমায় অদ্বিতীয় কুমিল্লার খাদি। তবে ভৌগোলিক নির্দেশক (জিআই) পণ্যের স্বীকৃতি তালিকায় এখনও অন্তর্ভূক্ত হয়নি কুমিল্লার খাদি। এনিয়ে আক্ষেপও রয়েছে কুমিল্লাবাসীর।
কুমিল্লার খাদি শিল্পের সঙ্গে জড়িতরা জানিয়েছেন, শতবর্ষের ঐতিহ্য, সুনাম ও খ্যাতি অক্ষুন্ন রাখার লড়াইয়ে এখনো টিকে রয়েছে কুমিল্লার খাদি। কালের পরিক্রমায় খাদি পরিণত হয়েছে বাঙালির অন্যতম ফ্যাশন প্রিয়তায়। শৈল্পিক ছোঁয়ায় কুমিল্লার খাদি এখন দেশ-বিদেশে বেশ সমাদৃত। খাদি কুমিল্লাকে ব্র্যান্ডিং করে। বর্তমানে খাদি শিল্পে অনেক নতুন নতুন ডিজাইন এসেছে, কারণ ১৯২১ সালের প্রেক্ষাপট ও চাহিদা এক নয়। শতবর্ষের খাদি পণ্য তার গুণগত মান বজায় রেখে আধুনিকতার সংমিশ্রণে হাল-ফ্যাশনের প্রতিযোগিতার বাজারে চাহিদা ধরে রেখেছে। পৃথিবীর যেখানেই বাঙালি কমিউনিটি আছে সেখানেই খাদি কাপড়ের চাহিদা রয়েছে। কেবল তাই নয়, বাংলাদেশের বাইরে অবাঙালিদের মাঝেও খাদি জনপ্রিয় হচ্ছে।
সমবায় আন্দোলনের পথিকৃৎ ব্যক্তিত্ব ও বার্ডের প্রতিষ্ঠাতা ড. আখতার হামিদ খানের চেষ্টায় ১৯৫২ সালের দিকে কুমিল্লার শহরের মনোহরপুরে অভয় আশ্রমে ‘দ্য খাদি অ্যান্ড কটেজ ইন্ডাস্ট্রিজ অ্যাসোসিয়েশন’ প্রতিষ্ঠিত হয়। অভয় আশ্রমের কর্মীদের প্রচেষ্টায় কুমিল্লার গ্রামগুলোতে হাতে সুতাকাটা ও হস্তচালিত তাঁতের ব্যবহার শুরু হয়। বিশেষ করে চান্দিনা উপজেলার আওরাল, বাড়েরা, মাধাইয়া, কুটুম্বপুর, বেলাশ্বর, হারং, রাড়িরচর, কলাগাঁও, গণিপুর, দেবিদ্বারের বরকামতা, সাইতলা, ফুলতলী, দোবারিয়া, বাখরাবাদ, ভানী, গুঞ্জর, দাউদকান্দির গৌরীপুর, মুরাদনগরের রামচন্দ্রপুর, রামকৃষ্ণপুর, ঘোড়াশাল, জাফরাবাদসহ জেলার বিভিন্ন এলাকায় হস্তচালিত তাঁতশিল্পের ব্যাপক প্রসার ঘটে এবং তাঁতশিল্পকে কেন্দ্র্র করে গ্রামের মানুষ হাতে সুতা কাটার পেশায় জড়িয়ে পড়ে। সময়ের পরিক্রমায় নানা সমস্যায় বর্তমানে তাঁতির সংখ্যা কমেছে। বর্তমানে কুমিল্লা সদর, চান্দিনা, দেবিদ্বার, মুরাদনগরে হাজার খানেক তাঁতি রয়েছেন। দেবিদ্বারের বরকামতায় ৫০টির জায়গায় এখন তাঁত চালু রয়েছে প্রায় ২০টি।
কুমিল্লার বাজারে সারা বছর খাদিপন্য বিক্রি হলেও ঈদ, নববর্ষ, পূজা বা বাঙালি সংস্কৃতির নানা উৎসবে খাদির পোষাকের ব্যবহার বেড়ে যায়। ঈদুল ফিতরকে সামনে রেখে রকমারি ডিজাইনের খাদিবস্ত্র তৈরি শুরু হয়েছে আরও মাসখানেক আগ থেকেই। এরপরও প্রতিদিনই খাদি কাপড় তৈরির কারখানাগুলোতে ব্যস্ত সময় পার করছেন কারিগররা।
বর্তমানে কুমিল্লা শহরে খাদির নাম সংযুক্ত দোকান আছে চার শতাধিক। নগরীর রাজগঞ্জ বাজারের পশ্চিম দিক থেকে কান্দিরপাড়ের রামঘাটলা পর্যন্ত এসব দোকানের অবস্থান। কুমিল্লার খাদিপন্যের দোকানগুলোতে হাতে বুনা সুতার কাজ, এন্ডিকটন, এন্ডিসিল্ক, আদি, এপ্লিক বাটিক, মটকা খাদি এবং খাদির মোটা ও পাতলা কাপড়ে স্কিন প্রিন্ট ও এম্বয়ডারিসহ সব ধরণের পাঞ্জাবি পাওয়া যাচ্ছে। এখন যুগের সাথে তাল মিলিয়ে খাদি কাপড়ের বিভিন্ন ডিজাইনের শাড়ি, থ্রি-পিস, টু-পিস, কুর্তা, শার্ট, ফতুয়া, টপস ইত্যাদি তৈরি হচ্ছে। তবে আধুনিক ডিজাইনের চাদরের ভিড়ে এখনও খাদির বøক প্রিন্টের চাদরের চাহিদা রয়েছে।
প্রবীণ ব্যবসায়ী ১৯৪৮ সালে প্রতিষ্ঠিত খাদিঘর’র স্বত্বাধিকারী প্রদীপ কুমার রাহা (কান্তি) বলেন, কাঁচামালের মূল্য বৃদ্ধি ও মজুরি খরচ বাড়ায় বর্তমানে খাদি কাপড়ের দাম কিছুটা বেড়েছে। তবে এটি ঠিক যে, দামে ও গুণমানে কুমিল্লার খাদির চেয়ে এত কম মূল্যে কোনো ব্র্যান্ডের ন্ডর কাপড় পাওয়া যায় না। হাতে তৈরি কাপড় হওয়ায় খাদির পোষাক পরে একটা ন্যাচরাল ফিল পাওয়া যায়। বাংলাদেশের বিদেশি দূতাবাসে খাদিসহ দেশীয় পণ্যের প্রদর্শনী করা যেতে পারলে এ পণ্যের ব্যাপক প্রসার ঘটাবে।
কবি নজরুল গবেষক অধ্যাপক শান্তিরঞ্জন ভৌমিক আক্ষেপ প্রকাশ করে বলেন, কুমিল্লার খাদি ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি না পাওয়া দুঃখজনক। জিআই পণ্য নিয়ে যারা কাজ করেন তাদের এবং কুমিল্লার জেলা প্রশাসনকে এ ব্যাপারে আরও আন্তরিক হতে হবে।
Last Updated on March 24, 2024 2:53 pm by প্রতি সময়